।।বিশেষ প্রতিবেদক।।
বৈশ্বিক ভূরাজনীতি ও অর্থনৈতিক বাস্তবতায় পরিবর্তনের এই যুগপর্বে একটি ঐক্যবদ্ধ ব্লক হিসেবে আবির্ভাব ঘটেছে ব্রিকসের (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা)। এই উত্থান পশ্চিমা আধিপত্যের প্রতি সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জের প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এসেছে। বৈচিত্র্যময় এই ব্লকটি পৃথিবীর ৩০০ কোটিরও বেশি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করছে, সংখ্যায় যারা বিশ্ব-জনসংখ্যার ৪২ শতাংশ। বৈশি^ক জিডিপির ২৩ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব ব্রিকসভূক্ত ৫ দেশের হাতে।বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠান আর ডলারের বিশ্বব্যাপী আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করতে চায় ব্রিকস। তারা এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার বাইরে একটি বহুপক্ষীয় ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলে আসছে। দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে আজ (মঙ্গলবার) শুরু হওয়া ব্রিকস সম্মেলনকে ঘিরে তাই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ যে প্রশ্নটি সামনে এসেছে; তা হলো সত্যিই এই জোট ডলার নির্ভর বিশ্ব-অর্থব্যবস্থার পশ্চিমা আধিপত্য রুখতে পারবে কিনা।
ব্রিকস যাত্রা শুরু করে ২০০৯ সালে। ২০১৪ সালে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক নামে একটি ব্যাংক চালু করে ব্লকটি। উদ্যোক্তা পাঁচ ব্রিকস দেশের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ৩২১ কোটি। জনসংখ্যা, আয়তন আর জিডিপির বিচারে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীন বিশ্বের প্রথম ১০টি দেশের অন্তর্ভুক্ত। ব্রিকসের পাঁচটি দেশই জি-২০-এরও সদস্য রাষ্ট্র। অর্থাৎ বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতিতে এই পাঁচ দেশের ভূমিকা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। পাঁচ-জাতির ব্লকের সম্ভাবনা সম্পর্কে আশাব্যঞ্জক ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন কিউবার প্রয়াত বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রো। ২০১৪ সালে ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত এই ব্লকের সম্মেলনের সময় তিনি ব্লকভূক্ত ৫ দেশের দ্বারা ‘পশ্চিমা পুনঃউপনিবেশ প্রচেষ্টা’ রুখে দেওয়ার সম্ভাবনা দেখেছিলেন।
পশ্চিমা শক্তিগুলি দীর্ঘকাল ধরে জাতিসংঘ এবং বিশ্বব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলিতে আধিপত্য করে আসছে। এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থায় তারা বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়েও হস্তক্ষেপ করে থাকে। এই অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্যকে ভেঙে দিতে চায় ব্রিকস। চীন প্রকাশ্যেই ঘোষণা করেছে, এবারের সম্মেলনে তারা জি-৭এর বিকল্প হিসেবে নিজেদের সামনে আনতে চায়। আজ মঙ্গলবার শুরু হওয়া ৩ দিনের বার্ষিক সম্মেলনের আয়োজক দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষে সে দেশের প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দি সিলভা, চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে সাদর অভ্যর্থনা জানানোর কথা। রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনও এই সম্মেলনে অংশ নেবেন, তবে ভিডিও কনফারেন্সের কারণে। তার বিরুদ্ধে ইউক্রেনে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানা ঝুলছে। সেই হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকার দায় রয়েছে, পুতিন সে দেশে গেলে তাকে গ্রেফতার করার। সে কারণেই পুতিনের বদলে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ সম্মেলনে রাশিয়ার প্রতিনিধিত্ব করবেন। ৩ মহাদেশের কয়েকশ কোটি মানুষের উচ্চপ্রবৃদ্ধির এই দেশগুলোর একটি অভিন্ন চাওয়া রয়েছে। তা হলো, পশ্চিমা ধনী রাষ্ট্রগুলোর বিদ্যমান একাধিপত্যকে ভেঙে দেওয়া।
দক্ষিণ আফ্রিকায় চীনের রাষ্ট্রদূত চেন শিয়াওডং এএফপিকে বলেছেন, ‘বিদ্যমান বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থা অকেজো হয়ে গেছে। এটি ত্রুটিপূর্ণ ও কার্যক্ষমতা হারিয়েছে।’ তার দাবি এমন বাস্তবতায় ব্রিকস ক্রমাগতভাবে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি দৃঢ় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে।
এশিয়া ও ব্রিকসে নিযুক্ত দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিনিধি অনিল সুখলাল গত শুক্রবার এএফপিকে বলেন, এককেন্দ্রিক এইবিশ্ব ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের সময় থেকে আরও বেশি এককেন্দ্রিক হয়েছে। সেখানে সব দেশকে কোনও না কোনও পক্ষ নিতে বাধ্য করার চেষ্টা চলছে। কাকে সমর্থন করতে হবে, কার সঙ্গে কী আচরণ করতে হবে কিংবা সার্বভৌম বিষয়গুলো কীভাবে নিষ্পত্তি হবে; দক্ষিণের রাষ্ট্রগুলো চায় না কেউ তা বলে দিক। তার দাবি, ব্রিকস বিশ্বব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর আশা সৃষ্টি করেছে।
পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম এক্সপ্রেস ট্রিবিউনের এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে, পাঁচ-দেশের ব্লকের ওই জোটনেতারা কী আলোচনা করার পরিকল্পনা করছেন; সে সম্পর্কে বিশদ বিবরণ খুব কম হলেও, পশ্চিমের বিকল্প হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার প্রশ্ন আলোচনায় থাকবে। আরও থাকবে বিশ্ব ডলারের একাধিপত্য প্রতিরোধ, বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বিকল্প আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রশ্নও।
এএফপি জানাচ্ছে, এই ব্লকে বিভিন্ন দেশের যোগ দেওয়ার আগ্রহ বাড়ছে। অন্তত ৪০টি দেশ এতে যুক্ত হওয়ার আগ্রহ দেখাচ্ছে, যাদের মধ্যে ২৩টি দেশ আনুষ্ঠানিক আবেদনও করে ফেলেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার লিমপোপো বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রভাষক লেবোগাং লেগোডিও বলছেন, বহু দেশ ব্রিকসে যোগ দিতে আগ্রহী। কেননা তারা ‘ব্রিকসকে বর্তমান আধিপত্যের বিকল্প হিসাবে দেখছে’। জোটের বাইরেও জোহানেসবার্গে প্রায় ৫০ জন বিশ্বনেতা ‘ব্রিকস বন্ধু’ হিসেবে সম্মেলনে যোগ দেবেন।
হাম্মাদ সরফরাজ এক্সপ্রেস ট্রিবিউনে লিখেছেন, সম্মেলনের একটি আকর্ষণীয় দিক হলো সৌদি আরব, তুরস্ক এবং মিশরের মতো দেশগুলির এই ব্লকে যোগদানের আগ্রহ। এমনকি এই ভূ-রাজনৈতিক ম্যাক্রো গেমের প্রাথমিক ইনিংসেও ব্রিকসের সম্প্রসারণকে এর অর্থনৈতিক ও অন্যান্য প্রভাবের সম্প্রসারণ হিসাবে দেখতে হবে। যদি নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণ করা হয়, ব্রিকস ইরানসহ পশ্চিমা-আধিপত্যের বিশ^ব্যবস্থা থেকে দূরে থাকা দেশগুলির জন্য একটি আকর্ষণীয় প্ল্যাটফর্ম হতে যারে। তিন দিনের শীর্ষ সম্মেলনের সময়, ব্রিকস নেতারা গ্রুপটি সম্প্রসারণের সম্ভাবনা নিয়ে একটি আলোচনার মুখোমুখি হবেন। প্রসঙ্গত, জোটের সদস্য দেশ রাশিয়া, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা সম্প্রসারণের পক্ষে হলেও ভিন্নমত রয়েছে ব্রাজিল আর ভারতের।
হাম্মাদ সরফরাজ বলছেন, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো নতুন সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করার মধ্য দিয়ে ব্লকটি সম্ভাব্যভাবে বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থায় গভীর পরিবর্তন ঘটাতে পারে। তেমনটা হলে, এই সম্প্রসারণ একটি রূপান্তরকারী অনুঘটক হিসাবে কাজ করতে পারে, যা ব্রিকসকে বিশ্ব মঞ্চে একটি কেন্দ্রীয় এবং প্রভাবশালী খেলোয়াড় হওয়ার পথে নিয়ে যেতে পারে। সদস্য সম্প্রসারণের বিষয়টি সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়বস্তু হিসেবে থাকবে বলে জানিয়েছেন ব্রিকসে নিযুক্ত দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিনিধি অনিল সুখলাল।
ব্রিকস ইতোমধ্যেই তার সদস্যরাষ্ট্র রাশিয়ার জন্য কার্যকর ভূমিকা নিয়ে আবির্ভুত হয়েছে বলে মনে করছেন দক্ষিণ আফ্রিকার উইটওয়াটার্সর্যান্ড বিশ^বিদ্যালয়ের কৌশলগত বিশ্লেষক মাল্টে ব্রোসিগ। তিনি বলছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ প্রমাণ হাজির করেছে যে কীভাবে ব্রিকস আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গঠনের জন্য সক্রিয়ভাবে চেষ্টা করছে। কোন ব্রিকস সদস্য রাশিয়ার আচরণের জন্য প্রকাশ্যে সমালোচনা করেননি, যা রাশিয়ার পদক্ষেপকে নির্মোহভাবে গ্রহণ করার মতোই ব্যাপার। ব্রিকস সদস্যরাও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এবং রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টা অনুসরণ করেনি। পরিবর্তে, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাগুলি ব্রিকস সদস্যদের তাদের নিজস্ব দুর্বলতা সম্পর্কে সতর্ক করেছিল। ডলারের আধিপত্য ভেঙে দেওয়া ও সদস্য বাড়ানোর আলাপও গতি পেয়েছে। রয়্যাল হলোওয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাউস ডডসও ব্রোসিগের সঙ্গে একমত। তিনি বলছেন, রাশিয়া ইতোমধ্যেই চীন ও ভারতকে পেয়েছে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলার ক্ষেত্রে।
এতোকিছুর পরেও অবশ্য সত্যিই ব্রিকস জি-৭ এর বিকল্প হয়ে উঠতে পারবে কিনা, ডলারসহ যাবতীয় অর্থে পশ্চিমা আধিপত্য ভেঙে দিতে পারবে কিনা; তা এখনও প্রশ্নসাপেক্ষ। বিশ্লেষকরা এর নেপথ্যে জোটভূক্ত দেশগুলোর সম্পর্কের প্রশ্নকেও সামনে এনেছেন। বিশেষত আলোচনায় এসেছে ভারত ও চীনের সম্পর্কের কথা। দুই দেশের মধ্যে যেমন ইতিবাচক সম্পর্ক আছে, তেমনি সীমান্তবিরোধসহ আরও অনেক নেতিবাচকতাও রয়েছে।
ব্রিকসের নাম দিয়েছিলেন জিম’ও নেইল নামের এক প্রখ্যাত ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ভারত, চীন, ব্রাজিল, রাশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা সম্মিলিতভাবে ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্ব অর্থনীতিতে আধিপত্য কায়েম করবে। সেই জিম’ও নেইলই সম্প্রতি ফিনান্সিয়াল টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এই মুহূর্তে ডলারের আধিপত্য ভেঙে দেওয়ার চিন্তা ‘হাস্যকর’। নেইল মনে করছেন, ২০০৯ সালের পর এ ব্যাপারে ব্রিকস জোটভূক্ত দেশগুলো কিছুই অর্জন করতে পারেনি।
আইএমএফের তথ্য অনুযায়ী, ডলারের আধিপত্য ভাঙার প্রশ্নে বিপুল আলোচনার মধ্যেই ২০২২ সালে বিশ্বর মুদ্রার ৬০ শতাংশ রিজার্ভ ছিল ডলারে। ওই বছরে আন্তর্জাতিক লেনদেনের ৮৮ শতাংশই ডলারে সম্পন্ন হয়েছে। কারটুইটি নামের এক সুবিশাল আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ব্যক্তি ডাইলান ক্রেমার তাই যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ফরচুনকে বলেছেন, ১০ বছরের মধ্যে ডলারের আধিপত্য ভাঙার কোনও সম্ভাবনা নেই।
ডলারের আধিপত্য ভাঙার ক্ষেত্রে নেইল প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখছেন চীন আর ভারতের সম্পর্ককে। তার মতে, এই দুই দেশের ঐকমত্য ছাড়া ডলারের আধিপত্য ভাঙা সম্ভব না। ‘এটি পশ্চিমের জন্য ইতিবাচক যে চীন এবং ভারত কখনই কোন বিষয়ে একমত হয় না। তারা যদি একমত থাকতে পারত, তাহলে ডলারের আধিপত্য অনেক বেশি ঝুঁকির মুখে পড়তো,’ তিনি ফিনান্সিয়াল টাইমসকে বলেছেন। ‘আমি প্রায়ই চীনা নীতিনির্ধারকদের বলি…আপনার অন্তহীন ঐতিহাসিক যুদ্ধগুলি ভুলে যান এবং কিছু বড় ইস্যুতে নেতৃত্ব ভাগ করে নেওয়ার জন্য ভারতকে আমন্ত্রণ জানানোর চেষ্টা করুন, কারণ তখন বিশ্ব আপনাকে আরও কিছুটা গুরুত্ব সহকারে নিতে পারে।’ বলেন নেইল।
সাউথ আফ্রিকান ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের স্টিভেন গ্রুজড এএফপিকে বলেন, আমি মনে করছি না এই সম্মেলন থেকে কোনও নাটকীয় ফল বেরিয়ে আসবে। কেননা ক্ষমতা এখনও পশ্চিমা দেশগুলোকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। চিন শক্তি অর্জন করছে, তবে এখনও চূড়ান্ত আধিপত্য প্রতিষ্ঠা থেকে দূরে আছে।
তথ্যসূত্র: এপি, এএফপি, ব্লুমবার্গ, ফিনান্সিয়াল টাইমস, ইকোনমিক টাইমস, মানি কন্ট্রোল, ফরচুন