আজ ১৬ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ ও ২রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ এবং ৮ই জিলকদ, ১৪৪৫ হিজরি

দুর্নীতিতে ভরা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর: তবুও পান পদোন্নতি

  • In জাতীয়
  • পোস্ট টাইমঃ ১৬ জুলাই ২০২৩ @ ০৭:৫৭ অপরাহ্ণ ও লাস্ট আপডেটঃ ১৬ জুলাই ২০২৩@০৭:৫৯ অপরাহ্ণ
দুর্নীতিতে ভরা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর: তবুও পান পদোন্নতি

।।নিজস্ব প্রতিবেদক।।

দুর্নীতির অভিযোগ যেন যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের পিছু ছাড়ছে না। অধিদপ্তরের তদন্তে সম্প্রতি ১৩কোটি ৯৬লাখ টাকার আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়া গেছে। বিগত ২বছরের মধ্যে এ নিয়ে সপ্তমবারের মতো আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ উঠলো।

যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের তদন্ত কমিটি এ বছরের শুরুর দিকে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ও সিলেটের জকিগঞ্জের স্থানীয় অ্যাকাউন্টস অফিসের ১০কর্মকর্তা-কর্মচারীর একটি সংঘবদ্ধ চক্রের প্রমাণ পায়। ডেপুটি সেক্রেটারি ফজলে এলাহীর নেতৃত্বে ৩সদস্যের কমিটির তদন্তে জানা গেছে, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আলী আশরাফ ২০২০-২০২১এবং ২০২১-২০২২অর্থবছরে জকিগঞ্জে যুবকদের জন্য একটি দক্ষতা প্রশিক্ষণ প্রকল্পে তহবিল বরাদ্দ করেছিলেন, যদিও ওই প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৯সালের নভেম্বরেই শেষ হয়ে যায়।

চলতি বছরের ৪জানুয়ারি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে জমা দেওয়া ওই তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কর্মকর্তারা ওই অর্থ উত্তোলন ও আত্মসাৎ করেছেন। অর্থ আত্মসাতে জড়িতরা হলেন- উপপরিচালক আলী আশরাফ, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের উপপরিচালক ফারহাত নূর, সহকারী পরিচালক ফজলুল হক, উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা আজহারুল কবির ও আবুল কালাম আজাদ, হিসাবরক্ষক নুরুল আমিন, অফিস সহকারী বাবুল পাটোয়ারী ও জসিম উদ্দিন, অ্যাকাউন্টস অফিসার কামাল হোসেন ও অডিটর ইকবাল মুন্সি।

এই অভিযোগ খতিয়ে দেখতে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। কমিটি জানায়, ২০১৯সালের নভেম্বর থেকে ২০২২সালের জুন পর্যন্ত ওই প্রকল্প থেকে ১৬কোটি ১৪লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। মেয়াদ না থাকা ওই ন্যাশনাল সার্ভিস প্রোগ্রামের জন্য তহবিল অনুমোদন করেছিলেন যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আজহারুল ইসলাম খান।

আজহারুল ইসলাম খান জানান, জকিগঞ্জসহ আরও কয়েকটি উপজেলার জন্য এই ধরনের তহবিল অনুমোদনের প্রস্তাব তার কাছে এসেছিল। তিনি ভুল করে জকিগঞ্জের প্রস্তাবটির অনুমোদন দিয়েছিলেন। তিনি আরো জানান- এ ঘটনায় যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ক্রীড়া মন্ত্রণালয় অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে অ্যাকাউন্টস অফিসার কামাল এবং অডিটর ইকবালের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে। চলতি বছরের শুরুতে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর জকিগঞ্জ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করার পর দুর্নীতি দমন কমিশন এ নিয়ে তদন্ত শুরু করে। তদন্ত চলাকালে সরকারি কোষাগারে ১কোটি টাকা ফেরত দেন জকিগঞ্জ উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা কবির।

দুর্নীতি করেও পদোন্নতি পেলেন:

গত বছর যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের ৫ টি পৃথক তদন্তে জানা গেছে যে, ৫জন সহকারী উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা যুবকদের ঋণ দেওয়ার নামে ২৬লাখ টাকার বেশি আত্মসাৎ করেছেন। তদন্তে দেখা গেছে- সহকারী উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা আনোয়ারুল কবির ১৭লাখ ৪হাজার টাকা, গোলাম ফারুক ২লাখ ৩৮হাজার টাকা, আইনুল ইসলাম ভূঁইয়া ১লাখ ৪৭হাজার টাকা, দীপক কুমার মণ্ডল ৩ লাখ ৮০হাজার টাকা এবং রফিকুল ইসলাম শেখ ১লাখ ৬২হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছেন।

বিভাগীয় ব্যবস্থা চলাকালেও তারা সবাই স্বীকার করেন যে তারা আর্থিক অপরাধে জড়িত। কিন্তু নথি থেকে জানা গেছে- অপরাধের সাজা হিসেবে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর শুধু তাদের বেতন কমিয়েছে ও পেনশন সুবিধা থেকে আত্মসাৎ করা টাকা উদ্ধারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এদিকে, আনোয়ারুল ছাড়া অভিযুক্তদের সবাই ২০২১সালের নভেম্বরে উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তার দায়িত্ব পেয়েছিলেন। একাধিক বিভাগীয় তদন্তে তাদের শাস্তির সুপারিশ করা হলেও তাদের কেউ কেউ পদোন্নতি পেয়েছেন। এজন্য কর্মকর্তাদের মধ্যে মোটা অঙ্কের টাকার ঘুষ লেনদেন হয়েছে বলে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

গত বছরের মে মাসে মন্ত্রণালয়ের তদন্তে দেখা গেছে, যোগ্য, সৎ এবং অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের বাছাই করার বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা উপেক্ষা করেই তাদের পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। ১১৭৫জন সহকারী উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তার তালিকা থেকে উপজেলা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের জন্য ৭০জন কর্মকর্তাদের বাছাই করেছিলেন যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের সাবেক উপপরিচালক (প্রশাসন) মোখলেছুর রহমান। তার বাছাই করা কর্মকর্তাদের মধ্যে ৪জনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত এবং ৭০জনই সুপারিশ করা কর্মকর্তাদের তালিকার সবচেয়ে নিচে ছিলেন, অর্থাৎ সবচেয়ে কম যোগ্য ছিলেন।

তদন্ত কমিটি ওই ৭০জন কর্মকর্তাদের মধ্যে ১জনের স্ত্রীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বেশ কয়েকটি সন্দেহজনক লেনদেনের সন্ধান পেয়েছে এবং এমন মেসেজের স্ক্রিনশর্ট খুঁজে পেয়েছে যেখানে একজন সহকারী উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা তার সহকর্মীকে অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাতে বলছেন। ঢাকার প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল গত বছরের ২৫জুলাই এক রায়ে ৭০জন সহকারী উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তার পদোন্নতির আদেশকে ”বেআইনি” বলে উল্লেখ করেন। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বিভিন্ন বৈঠকেও ওই আদেশ বাতিলের নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর এখনও আদেশ বাতিল করেনি।

পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বেশ কয়েকজন যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা জানান- দুর্নীতিগ্রস্তদের যদি সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চাকরিচ্যুত না করা হয় তবে এই ধরনের অর্থ আত্মসাতের ঘটনা বারবার ঘটতে থাকবে। অভিযোগের বিষয়ে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের সাবেক উপপরিচালক মোখলেছুর রহমান তদন্ত কমিটিকে বলেছেন, তিনি শুধু যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) এবং মহাপরিচালকের নির্দেশ পালন করেছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আজহারুল ইসলাম খান সরাসরি কোনো উত্তর না দিয়ে জানান- সাধারণত যেসব ফাইল তার সামনে রাখা হয় তার বিস্তারিত দেখা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। তদন্ত কমিটি সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে বিস্তারিত তদন্ত ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জড়িত কি’না তা খুঁজে বের করতে একটি পৃথক তদন্ত কমিটি করার সুপারিশ করেছে। কিন্তু এটি এখনো গঠন করা হয়নি।

মন্ত্রণালয়ের সচিব মেজবাহ উদ্দিন সেসময় মোখলেছুরের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করলেও গত বছরের ডিসেম্বরে তিনি মোখলেছুরকে খালাস দেন। যোগাযোগ করা হলে মেজবাহ উদ্দিন জানান- আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তিনি মোখলেছুরকে খালাস দিয়েছেন।

আর্থিক লেনদেন এবং এর সঙ্গে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের পরিচালক ও মহাপরিচালকের ভূমিকা খতিয়ে দেখতে কেন এখনো কমিটি গঠন করা হয়নি জানতে চাইলে তিনি বলেন- কমিটি গঠনের বিষয়ে আমি বর্তমান সচিবের সঙ্গে কথা বলব।

মোখলেছুর রহমানকে উপপরিচালক হিসেবে নরসিংদীতে বদলি করা হয়েছে। তবে নরসিংদীতে তার কয়েকজন সহকর্মী জানান- তিনি প্রায়ই অফিসে অনুপস্থিত থাকেন এবং প্রধান কার্যালয়ে সময় কাটান। যদিও এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মোখলেছুর রহমান। নিয়মিত অফিসে যান বলে দাবি করেন তিনি।

নিউজ শেয়ারঃ

আরও সংবাদ

জনপ্রিয় সংবাদ

সর্বশেষ সংবাদ

আলোচিত সংবাদ

নিউজ শেয়ারঃ
শিরোনামঃ
Verified by MonsterInsights