আজ ২৬শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ ও ১১ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ এবং ২০শে মহর্‌রম, ১৪৪৬ হিজরি

জাল টাকা তৈরির কারবারিরা অপ্রতিরোধ্যঃ দুর্বল আইনই দায়ী

  • In বিশেষ সংবাদ
  • পোস্ট টাইমঃ ১৭ জুন ২০২৩ @ ০৯:৫৬ পূর্বাহ্ণ ও লাস্ট আপডেটঃ ১৭ জুন ২০২৩@০৯:৫৮ পূর্বাহ্ণ
জাল টাকা তৈরির কারবারিরা অপ্রতিরোধ্যঃ দুর্বল আইনই দায়ী

।।বিশেষ প্রতিবেদন।।

প্রতি বছর দুই ঈদের আগে বিপুল অংকের নতুন টাকা বাজারে ছাড়ে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন টাকা বাজারে আসাকে ঘিরে অপতৎপরতা বেড়ে যায় জালটাকার কারবারিদের। আসন্ন কোরবানির ঈদ ঘিরে এবারও রাজধানীর পশুর হাটসহ সারাদেশে জালটাকা ছড়িয়ে দিতে তৎপর হয়ে উঠেছে একাধিক জাল টাকা প্রস্তুতকারী চক্র।

আগে অনেকটা গোপনীয়তার সঙ্গে অফলাইনে জালটাকার কারবার হলেও এখন ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে জালনোট কেনাবেচা হচ্ছে। ফলে যে কেউ সহজেই এ কারবারে জড়িয়ে পড়ছে। সবচেয়ে বেশি জাল হচ্ছে ১০০০ টাকার নোট। এতে জাল টাকা কারবারিদের লভ্যাংশ অনেক বেশি থাকে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন- দেশের অর্থনীতির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর কাজ জালটাকার বিস্তার। সঠিকভাবে প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না, এ সংক্রান্ত অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারায়। কারণ যে কোনো অপরাধ দমনের অন্যতম প্রধান উপায় হচ্ছে সংঘটিত অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করা। মূলত আলাদা আইন না থাকা এবং বিদ্যমান আইনের দুর্বলতার কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারির মধ্যেও এই অপকর্ম থামছে না। জানা যায়, আইনি দুর্বলতার কারণে জালনোট সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তিতে তেমন গতি নেই। জরিপ বলছে- বছরের পর বছর ঝুলছে জালনোটের প্রায় ছয় শতাধিক মামলা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জানুয়ারি-মে) বিভিন্ন মূল্যমানের জালনোট ধরা পড়েছে প্রায় সাড়ে ৩হাজার পিস। যার মূল্যমান ৩০লাখ টাকার বেশি। তবে গত কয়েক মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে কয়েক কোটি টাকার জালনোট ধরা পড়ার ঘটনা সংবাদের খোরাক হিসেবে বহুবার প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্রিকায়।

সংশ্লিষ্টরা জানান- জালনোট প্রতিরোধে দেশে আলাদা কোনো আইন নেই। ফলে বিদ্যমান আইনে অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনার ক্ষেত্রে নানা ধরনের জটিলতা তৈরি হচ্ছে। এ ছাড়া জালনোট সংক্রান্ত মামলার শুনানির দিনে হয়রানির ভয়ে সাক্ষীরা প্রায় ক্ষেত্রে উপস্থিত হয় না। এতে করে মামলার কার্যক্রম বিঘ্নিত ও বিলম্বিত হয়। ফলে কারবারিরা ধরা পড়ার পরও আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে জামিনে বের হয়ে আবারও একই অপকর্মে লিপ্ত হয়। এটা হল দুর্বল আইনের প্রতিফলন।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন- জালটাকা দেশের অর্থনীতির জন্য শুভ নয়। এটা আমাদের বড় সমস্যা। এটা প্রতিরোধে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষ করে জালনোটের মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া উচিত। আর যত দ্রুত সম্ভব উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত।

কোরবানির ঈদ উপলক্ষে আগামীকাল রবিবার থেকে নতুন নোট বাজারে ছাড়া হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল কার্যালয়সহ সব শাখা কার্যালয় এবং বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের ৬০টি শাখায় নতুন নোট বিনিময়ের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্রে জানা যায়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জালনোট তৈরি ও ছড়ানোর একাধিক চক্র রয়েছে। কোরবানির ঈদকে ঘিরে এসব চক্রের অপতৎপরতা বেড়েছে। তারা পুরাতন টাকার ভেতরে জাল নোট ঢুকিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে।

খবরে জানা যায়, সর্বশেষ গত ৩জুন রাতে গোপালগঞ্জ জেলা সদরের বেদগ্রামের দক্ষিণপাড়া এলাকার এক প্রবাসীর বাড়িতে অভিযান চালিয়ে জালটাকা তৈরির সরঞ্জামসহ এক দম্পতিকে আটক করে পুলিশ। ওই বাড়ির একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে জাল টাকা তৈরি করে আসছিলেন কামরুল ইসলাম ও হোসনা বেগম দম্পতি। তাদের কাছ থেকে ৭লাখ ১০হাজার টাকার জালনোট জব্দ করা হয়।

এর আগে গত ২৪মে সাভারের একটি পোশাক কারখানার ভেতর থেকে ৫০লাখ টাকার জালনোটসহ তিনজনকে আটক করা হয়। সাভার উপজেলার বনগাঁও ইউনিয়নের সাদাপুর পুরানবাড়ি এলাকার ‘সাউথ বেঙ্গল এ্যাপারেলস লিমিটেড’ নামের ওই পোশাক কারখানার ভেতরেই জালটাকা তৈরির কারখানা গড়ে তোলেন এর মালিক সাখাওয়াত হোসেন খান। ওইদিন জালটাকা দিয়ে লিচু কিনতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন তিনি। এরপর কারখানা থেকে নাজমুল হোসেন ও সুজন মিয়াকে আটক করা হয়। এর বাইরেও গত কয়েক মাসে বিপুল অংকের জালটাকাসহ বেশ কয়েকজনকে আটকের ঘটনা ঘটেছে।

জালনোট ধরা পড়ার পরিসংখ্যানঃ বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে- চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত পাঁচ মাসে বিভিন্ন মূল্যমানের ৩হাজার ৫৭৮টি জালনোট নোট ধরা পড়েছে। এর মধ্যে এক হাজার টাকার নোটই রয়েছে ২হাজার ৫৫১টি। এ ছাড়া ৫শ টাকার ৮৮৮টি, ২শ টাকার ৫টি ও ১০০টাকার ৭৪টি নোট রয়েছে। এসব নোটের মোট আর্থিক মূল্য ৩০লাখ ৩হাজার ৪শ টাকা। যা বিজ্ঞ মহলকে ভাবিয়ে তুলেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোঃ আবুল বশর জানান, সাধারণত দুই ঈদের আগে নোট জালকারী চক্রের অপতৎপরতা বৃদ্ধি পায়। তাদের অপতৎপরতা প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারির পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নানা কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জাল নোট বিক্রিঃ

গত বুধবার রাতে ‘এ-গ্রেট জালনোট’ নামের ফেসবুক গ্রুপ থেকে আলামিন ফ্যাশন নামের আইডি হতে ‘জালটাকা বিক্রি’ শিরোনামে একটা স্ট্যাটাস দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, আমাদের মালের অনেক চাপ। তাই এখন থেকে সর্বনিম্ন অর্ডার ৫০হাজার টাকা, সঙ্গে ডেলিভারি চার্জ ফ্রি এবং ২লাখ টাকার ওপরে অর্ডার করলে ৩হাজার টাকা ডিস্কাউন্ট দেওয়া হবে। সব নতুন ৫০, ১০০, ২০০, ৫০০, ১০০০ নোট পাবেন। এর মধ্যে ১০০, ২০০ ও ৫০০ টাকার নোট বেশি আছে। মাল নিতে হলে আপনার নাম, ফোন নম্বর ও ঠিকানাসহ মেসেজ করুন এবং রিপ্লাই পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন। এই হল ডিজিটাল যুগের আধুনিক জাল নোট সরবরাহকারীর ব্যবসায়িক অবস্থা।

“জালটাকা বিক্রির ডিলার” নামের আরেক ফেসবুক আইডি থেকে গত ১৭মে একটা পোস্ট দেওয়া হয়। ওই পোস্টে ০১৭৯৪-৬১৭৮** নম্বরে ইনবক্স করার আহ্বান জানিয়ে বলা হয়- আমাদের কাছে পাবেন এ গ্রেট সলিড কাজ। জিএস আর কাগজের, জল ছাপ, স্পষ্ট সুতাসহ নিখুঁত কাজের মাল। কত টাকার নোট কত লাখ অথবা কত হাজার লাগবে, নাম নম্বর ও ঠিকানা দিন। জাল নোট কারবারিদের সাহস কতটা এটাই তার নমুনা। আর আইনের প্রতি তারা কতটা উদাসীন এ থেকেই বোঝা যায়।

মামলা নিষ্পত্তিতে গতি নেইঃ

গত এপ্রিল পর্যন্ত জালনোটের অনিষ্পন্ন মামলার পরিমাণ ৬হাজার ৮৮০টি। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত অনিষ্পন্ন মামলার সংখ্যা ছিল ৬হাজার ৮৩৬টি। এর মানে গত চার মাসে অনিষ্পন্ন মামলার সংখ্যা বেড়েছে ৪৪টি। এর মধ্যে চলতি বছরের প্রথম চার মাসে (জানুয়ারি-এপ্রিল) জালনোটের নতুন মামলা হয়েছে ৩৬টি। একই সময়ে মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ৩৮টি। যত দ্রুত মামলা আছে ঠিক তত দ্রুতই মামলা নিষ্পত্তি হয়ে যাচ্ছে।

গত বছর ১৩২টি নতুন মামলার বিপরীতে ১৭০ টি নিষ্পত্তি হয়। তবে তার আগের বছর ২০২১সালে ১৬৬টি নতুন মামলার বিপরীতে মাত্র ২০টি নিষ্পত্তি হয়। এ ছাড়া করোনা মহামারীর বছর ২০২০সালে ১৩৬টি মামলা হয়, নিষ্পত্তি হয় ৭৮টি। সব মিলিয়ে ২০১৩থেকে ২০২৩সালের এপ্রিল পর্যন্ত ১০বছর চার মাসে ২হাজার ৪৮৬টি নতুন মামলা হয়েছে। এর বিপরীতে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ১হাজার ১৫টি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন- জালনোটের কারবারিদের শাস্তি নিশ্চিত করা না গেলে জালনোট ছড়ানোর প্রবণতা বাড়তে থাকে। এ জন্য জালনোটের মামলাগুলো সংবেদনশীল হিসেবে দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া দরকার। পাশাপাশি জালনোটের মামলা থেকে আসামিরা যাতে জামিন নিয়ে বের হতে না পারে, সে দিকটিও নিশ্চিত হওয়া দরকার।

হয়নি পৃথক আইনঃ

বর্তমানে দ-বিধি ১৮৬০-এর ৪৮৯ (ক)-(ঘ) ধারা এবং বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪-এর ২৫ (ক) ধারা অনুযায়ী জালনোটের বিচার হয়। এ আইনে কারও বিরুদ্ধে শাস্তি দিতে গেলে প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী হাজির করতে হয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হয়রানির ভয়ে প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী হাজির হয় না। এ বাস্তবতায় কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে একটি আইনের খসড়া প্রণয়নে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে ২০১৫সালে একটি কমটি হয়। ওই কমিটি ‘জাল মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ আইন ২০১৭’-এর খসড়া তৈরি করে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। ৬বছর পেরিয়ে গেলেও নতুন আইন এখনো হয়নি। খসড়ায় প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীর পরিবর্তে জব্দ আলামতের ভিত্তিতে শাস্তির বিধান করার প্রস্তাব রয়েছে। আর সর্বোচ্চ শাস্তির প্রস্তাব করা হয়েছে আমৃত্যু কারাদন্ড এবং এক কোটি টাকা জরিমানা।

জালনোট প্রতিরোধে ব্যাপক প্রস্তুতি বাংলাদেশ ব্যাংকেরঃ

রাজধানীসহ সারাদেশ অনুমোদিত পশুর হাটগুলোতে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে ব্যাংকের মাধ্যমে নোট যাচাই সংক্রান্ত সেবা প্রদান করা হবে। সেই সঙ্গে সারাদেশের হাটগুলোতে নোট জালকারী চক্রের অপতৎপরতা রোধকল্পে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবিসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার কার্যক্রম জোরদার করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো হয়েছে। এ ছাড়া জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে ব্যাংকের শাখায় গ্রাহকদের জন্য স্থাপিত টিভি মনিটরে আসল ব্যাংক নোটের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যসংবলিত ভিডিওচিত্র প্রচারের জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।

নিউজ শেয়ারঃ

আরও সংবাদ

জনপ্রিয় সংবাদ

সর্বশেষ সংবাদ

আলোচিত সংবাদ

নিউজ শেয়ারঃ
শিরোনামঃ
Verified by MonsterInsights