আজ ১৭ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ ও ৩রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ এবং ৯ই জিলকদ, ১৪৪৫ হিজরি

উত্তরবঙ্গের দর্শনীয় ও সনাতন ধর্মের তীর্থস্থান সিন্দুরমতি দিঘীর ইতিহাস ও ঐতিহ্য

  • In বিশেষ সংবাদ
  • পোস্ট টাইমঃ ১৫ জুলাই ২০২৩ @ ১০:৪৮ পূর্বাহ্ণ ও লাস্ট আপডেটঃ ১৫ জুলাই ২০২৩@১০:৪৮ পূর্বাহ্ণ
উত্তরবঙ্গের দর্শনীয় ও সনাতন ধর্মের তীর্থস্থান সিন্দুরমতি দিঘীর ইতিহাস ও ঐতিহ্য

নিজস্ব প্রতিবেদক
মোঃ বিপুল ইসলাম।।

উত্তরবঙ্গের লালমনিরহাট জেলার পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নে অবস্থিত সিন্দুরমতির দিঘী। এই দিঘীকে কেন্দ্র করে রয়েছে ঐতিহাসিক কাহিনী । উত্তরবঙ্গে ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো মধ্যে এই দিঘীটি অন্যতম। ইতিহাস থেকে জানা যায়, জমিদার নারায়ণ চক্রবর্তীর জীবনীকে কেন্দ্র করেই এই দিঘীর উৎপত্তি লাভ। আয়তনের দিক থেকে এই দিঘীটি প্রায় ১৬ একর ৫ শতক জমিতে অবস্থিত।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রায় তিনশ বছর পূর্বে নারায়ণ চক্রবর্তী নামে একজন নিঃসন্তান ব্রাহ্মণ জমিদার সন্তান লাভের আশায় তীর্থ স্থান গুলো ভ্রমণের জন্য নৌপথে এখানকার দেউল সাগর মন্দিরে এসেছিলেন। তখন দেউল সাগর সনাতন ধর্মের মানুষের একটি প্রসিদ্ধ তীর্থ স্থান হিসেবে পরিচিত ছিলো এবং ‌বহু রাজ্যের রাজা এই স্থানটি পরিদর্শন করতে এসেছিলেন। প্রাচীনতম এই মন্দিরটি চারপাশে থেকে পানি দ্বারা বেষ্টিত ছিল।

নারায়ণ চক্রবর্তী ও তার সহধর্মিনী শ্রীমতী মেনেকা দেবী এখানে ত্রিদিবস-রজনী যাপনের জন্য এসেছিলেন। পরে এই স্থানের মনোরম পরিবেশের আকর্ষণে আর ফিরে যাননি। তারা এখানে নতুন আবাসস্থল বা রাজ্য গড়ে তোলেন। তাদের নিরন্তর প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে এই এলাকা পরিণত হয় এক শান্তির রাজ্যে। প্রতিষ্ঠিত হয় রাজ নারায়ণ চত্রুবর্তীর জমিদারিত্ব। অন্যদিকে শ্রীমতী মেনেকা দেবীর গর্ভ থেকে জন্ম নেয় ফুটফুটে দুই কন্যা সন্তান যাদের নাম রাখা হয়- সিন্দুর ও মতি। আর সময়ের বিবর্তনে দিনে দিনে সিন্দুর ও মতি শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে পদার্পণ করেন। ঠিক এই সময় জমিদারের সুখী সমৃদ্ধ রাজ্যে আকস্মিকভাবে দেয় তীব্র খরা। পানি অভাবে খাল-বিল সব শুকিয়ে যায়। রাজ্যজুড়ে হাহাকার হয়ে পড়ে ।

এমতাবস্থায় জমিদার পানি সংকট নিবারণের জন্য জরুরি ভিত্তিতে একটি বিশাল দিঘি খননের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। পরে কয়েক হাজার শ্রমিক দিনের পর দিন দিঘি খনন করতে থাকে কিন্তু পানির সন্ধান মিলে না। এমন অবস্থায় চিন্তিত হয়ে পড়েন জমিদার। তার পর জমিদার রাতে ঘুমাতে গেলে স্বপ্নে আদেশ প্রাপ্ত হন তিনি। আদেশটি এমন ছিল যে, তার দুই কন্যাকে দিঘির মাঝখানে যথারীতি উপাচারসহ ভগবানের পূজা করলে পানি আসবে। স্বপ্নের আদেশ অনুযায়ী জমিদার রাম-নবমীর দিনের পূজার আয়োজন করেন। এ খবর শুনে এলাকার লোকজন এসে দিঘির পাড়ে ভীর জমায়েত থাকেন। পরে জমিদার তার আদরের দুই কন্যাকে সাজিয়ে-গুছিয়ে নিয়ে দিঘির পাড়ে এসে হাজির হন।

ইতিহাস থেকে আরো জানা যায়, সিন্দুরের পরনে ছিল লাল শাড়ি আর মতির পরনে সাদা শাড়ি। পড়ে জমিদার পাঠা বলি দিয়ে পূজার কার্য শুরু করে। দিঘির মাঝখানে আলপনা এঁকে পূজার নৈবেদ্যসমুহ সুবিন্যাস্তভাবে সাজানে হয়। চারিদিকে ঢাক-ঢোল বাজতে থাকে। সবার দৃষ্টি দিঘির তলদেশের দিকে কিন্তু সামান্যতমও পানিও উঠেনা পরে এমন তো অবস্থায় হঠাৎ জমিদারের মনে পড়ে যায় যে, ভুল বশত তুলসী পাতা আনা হয়নি তখন জমিদার তুলসী পাতা আনতে চলে যায় সিন্দুর ও মতিকে দিঘির গভীরে রেখে। অন্যদিকে দিঘির গভীরতম স্থান ভেদ করে বিকট শব্দে তীব্র বেগে জলরাশি বের হয়ে নিমিষেই দিঘি জলে পূর্ণ হয়ে যায়। পূজার চালুনি-বাতি ও নৈবেদ্যসহ বলিকৃত পাঠা জলের উপর ভেসে ওঠে। ঢাক- ঢোল বাদকরা কোনো রকমে সাতরিয়ে ভেসে উঠে কিন্তু সিন্দুর আর মতি থেকে যায় দিঘির গভীর স্থানে। পরে জমিদার ছুটে এসে দেখে দিঘীটি পানিতে কানায় কানায় পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু তার আদরের কন্যারা পানির নীচে পড়ে রয়েছে এবং তারা আর জীবিত নেই।

এই কথা শুনে জমিদার কষ্টে আতঙ্কে দিঘিরপাড়ে আছড়ে পড়েন। আর অন্যদিকে এমন অবস্থা দেখে জমিদারের স্ত্রী মেনেকা দেবীও কন্যার শোকে এ দিঘির পানিতে ঝাঁপ দিয়ে নিজের সন্তানদেরকে বাঁচানোর চেষ্টা করে কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। পরে জমিদারের শুভাকাঙ্ক্ষী ও শূন্য সামন্ত তাদেরকে প্রাসাদে নিয়ে যায়। দুই কন্যার মৃত্যুতে শোকাহত জমিদার রাতে স্বপ্নে আবার অবগত হন যে, তার কন্যাদ্বয়ের মৃত্যু হয়নি। তারা দিঘির তলদেশে দেবত্বপ্রাপ্ত হয়ে অমরত্ব লাভ করেছেন। কিন্তু জমিদারি ইচ্ছা ছিল তার দুই কন্যাকে একবারের জন্য হলেও দেখতে চাওয়া তারা অমরত্ব লাভ করেছে কি না। ঠিক সেই ধারাবাহিকতায় জমিদার ও তার স্ত্রীসহ সেই সময়ে স্থানীয় লোকজন ঘটনার আট দিন পর সূর্যোদয়ের পূর্বে দিঘির পারে আসলে তারা দেখতে পান তাদের দুই কন্যা নিজ নিজ শাড়ির আঁচল এবং কানি আঙ্গুল তুলে ধরছে পানির উপরে। কানি আঙ্গুল তুলে ধরা কারণ যেন তাদের বাবা-মা বুঝতে পারে তাদের কন্যা সন্তানরা অমরত্ব লাভ করেছে। পরে জমিদার ও তার স্ত্রী এ সময় দেবত্বপ্রাপ্ত দুই কন্যা সিন্দুর ও মতির সঙ্গে কথাও বলেছিলেন বলে জানা যায়। আর এই দুই কন্যার নামানুসারের দিঘিসহ এলাকাটির নাম হয়েছে সিন্দুরমতি।

এখন প্রতি বছর চৈত্র মাসের রাম-নবমীতে সিন্দুরমতির পূজা উপলক্ষ্যে দিঘির পাড়ে বিরাট মেলা বসে এবং শত শত পাঠা বলি দেয়া হয়। রাম-নবমীতে দূরদূরান্ত থেকে অগনিত দম্পতি এখানে আসে যুগল স্নানের জন্য। সুখ-শান্তিময় দাম্পত্য জীবন লাভের আশায় দিঘির জলে ডুব দেয়। প্রাচীনকাল থেকেই এ প্রথা চলে আসছে। আর এই বিশ্বাসে এলাকাবাসী দিঘির পাড়ে এক মাসব্যাপী ‘নাম যঞ্জ’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন।

সিন্দুরমতির পূজার জন্য দিঘির উত্তর-পূর্ব কোণে রয়েছে তাদের প্রতিমাসম্বলিত একটি মন্দির। তবে এই নির্মিত মন্দিরটির স্থাপনকাল সম্পর্কে জানা যায়নি। ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রথম সংস্কার ঘটেছিল বাংলা ১৩৭৬ সালে আর সর্বশেষ সংস্কার ঘটে। বাংলা ১৪০০ সালে শ্রী কামিনী মোহন সরকারের মাধ্যমে। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে সিন্দুরমতি দিঘি সরকারি উদ্যোগে আংশিকভাবে পুনর্খননের সময় এখানে মূল্যবান অনেক মুদ্রা, মূর্তি ও পাথর পাওয়া যায়, যা জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষণ রয়েছে।

এখানে প্রতিবছর মেলায় বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ছাড়াও পাশের দেশ ভারত থেকে হাজার হাজার সনাতন ধর্মের লোকজন পূণ্য লাভের আশায় এ দিঘিতে আসেন। সবমিলিয়ে জমে উঠে সিন্দূরমতি মেলা।

নিউজ শেয়ারঃ

আরও সংবাদ

জনপ্রিয় সংবাদ

সর্বশেষ সংবাদ

আলোচিত সংবাদ

নিউজ শেয়ারঃ
শিরোনামঃ
Verified by MonsterInsights