।।বিশেষ প্রতিবেদক।।
সংঘাত সংঘর্ষ ছাড়াই শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হওয়া সিলেট ও রাজশাহী সিটির নির্বাচনে বিপুল ভোটে সহজ জয় পেয়েছেন নৌকার প্রার্থীরা। সরকারি ফলাফল অনুযায়ী, রাজশাহীতে-নৌকার প্রার্থী এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন এবং সিলেটে মেয়র পদে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী জয় পেয়েছেন।
এই দুই সিটিতেই নৌকার বিপক্ষে হাল ধরার মত কোন শক্তিশালি প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলো না। ফলে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বির সাথে ভোটের ব্যবধানও ছিলো ব্যাপক। ভোট পরবর্তি সংবাদ সম্মেলনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের বলেন, পাঁচ সিটি করপোরেশন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে উৎসাহিত করবে।
রাজশাহী: সরকারি ফলাফল অনুযায়ী, রাজশাহীতে-নৌকার প্রার্থী এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন পেয়েছেন ১ লাখ ৫৯ হাজার ৭৯৭ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী সাইফুল ইসলাম স্বপন পেয়েছেন ৯ হাজার ৪৫৭ ভোট। গোলাপফুল প্রতিক নিয়ে ইসলামী জাকের পার্টির প্রার্থী লতিফ আনোয়ার পেয়েছেন ১১ হাজার ৫৮৪ ভোট। হাতপাখার প্রার্থী মুরশীদ ফারুকী পেয়েছেন ১৩ হাজার ৩৯৩ ভোট।
যদিও বরিশালে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীমের উপর হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে শেষ সময়ে এসে নির্বাচন বর্জন করেন মুরশীদ ফারুকী। এই চার প্রার্থীর মধ্যে হেভিওয়েট নৌকার প্রার্থী ও সাবেক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের মুল প্রতিদ্বন্দ্বি ছিলেন লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী সাইফুল ইসলাম স্বপন।
রাজশাহীতে বুধবার সকাল ৮টা থেকে ইভিএমে শুরু হয় রাজশাহী সিটির ভোটগ্রহণ যা চলে বিকেল চারটা পর্যন্তু। কিন্তু সকাল ৭টা থেকেই নগরীর বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে ভোটাদের দীর্ঘ সারি দেখা যায়। রাজশাহীতে এবারই প্রথম ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট দিয়েছেন ভোটাররা।
তাই অনেকের মাঝে ছিলো বাড়তি আগ্রহ। কিন্তু সকাল ১১টায় হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলে বিপাকে পড়ে ভোটারা। ফলে ৪০ মিনিট ধরে কেন্দ্রে ভোট দিতে পারেনি তারা। বৃষ্টি থামলে ধীরে ধীরে আবারো কেন্দ্রগুলোতে ভোটার উপস্থিতি বাড়তে থাকে।
সকাল ৯টায় নগরীর স্যাটেলাইট টাউন হাইস্কুল কেন্দ্রে স্ত্রী ও দুই কন্যাসহ ভোট দেন নৌকার প্রার্থী এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। এসময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন,শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট চলছে। কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। কয়েকটি কেন্দ্রে ইভিএম মেশিনে সমস্যা হয়েছে। সেগুলো রিপ্লেস করা হচ্ছে বলে ইসি জানিয়েছে।
সকাল ১০টায় নগরীর আটকোষী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দেন লাঙ্গলের প্রার্থী সাইফুল ইসলাম স্বপন। এসময় গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ইভিএমে ঘণ্টায় ১৩ থেকে ১৪টা ভোট হচ্ছে। শত শত মানুষ গরমের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে।
ভোট নিতে নিতে ইভিএম অচল হয়ে যাচ্ছে। মেশিন যদি অচলই হয়ে যাবে তাহলে এগুলো আনলো কেন? ১০ দিন আগে প্রস্তুতি নেয়নি কেন? এই নির্বাচন কমিশন একটা অপদার্থ।
দুপুর ১২টায় ১০ নম্বর ওয়ার্ডের হেতমখাঁ গোরস্থান এলাকার মুসলিম হাই স্কুল কেন্দ্রে ভোট দেন জাকের পার্টির মেয়র প্রার্থী লতিফ আনোয়ার। ভোট দিয়ে তিনি বলেন, আমি সরকার ও দেশের জনগণকে বিশ্বাস করি তাই কোথাও পুলিং এজেন্ট দেয়নি। তার মানে এই নয় যে আমাদের জাকের পার্টি নরম, দুর্বল। আমাদের সারাদেশের প্রচুর সমর্থক ও কর্মী আছে। এদিকে হাতপাখার প্রার্থী মুরশিদ ফারুকী জানান, নির্বাচনে নিজের ভোট দিতেও যাননি তিনি। তাই এব্যাপারে তিনি কথা বলতে চান না।
দুই/একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া রাজশাহী সিটি নির্বাচন ছিলো শান্তিুপূর্ণ। পুরো এলাকা ছিলো নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা। সুষ্ঠ নির্বাচনের লক্ষ্যে ভোটকেন্দ্রগুলোতে স্থাপন করা হয়েছিল এক হাজার ৫৬০টি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা। রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবন থেকে সিসি ক্যামেরায় রাজশাহী ও সিলেট সিটি ভোট পর্যবেক্ষণের এক পর্যায় কমিশন দেখে যে, একজন মহিলা একাধিকবার মহিলা ভোটারদের নিয়ে গোপন কক্ষে প্রবেশ করছে।
এরপর কমিশনারগণ প্রিসাইডিং অফিসারের সাথে যোগাযোগ করেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এসে ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে তাকে তিনদিনের জেল দিয়ে দেন। রাজশাহী সিটির ২৮ নং ওয়ার্ডেও ১৪১ নং কেন্দ্রে তালাইমারী দারুল উলুম আলিম মাদ্রাসার নিচতলা এ ঘটনা ঘটে।
এছাড়া ভোট চলাকালে দুপুর ১টার দিকে নগরীর ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কেশবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রের বাইরে ‘টিফিন ক্যারিয়ার’ প্রতীকের প্রার্থী রুহুল আমিন টুনু ও ‘র্যাকেট’ প্রতীকের প্রার্থী আশরাফুল ইসলাম বাবুর সমর্থকদের মধ্যে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।
সিলেট: এদিকে রাজশাহীর জয়ের হাওয়া লেগেছে সিলেটের নৌকার পালে এখানেও বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছে নৌকার প্রার্থী। সরকারি ফলাফল অনুযায়ি সিলেটে মেয়র পদে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী নৌকা প্রতীকে পেয়েছেন ১ লাখ ১৯ হাজার ৯৯১ ভোট, তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাবুল লাঙ্গল প্রতীকে পেয়েছেন ৫০ হাজার ৮২৬ ভোট।
এছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. আব্দুল হানিফ কুটু ঘোড়া প্রতীকে পেয়েছেন ৪২৯৬, মো. ছালাহ উদ্দিন রিমন ক্রিকেট ব্যাট প্রতীকে ২৬৪৮ মো. শাহজাহান মিয়া বাস প্রতীকে ২৯৬৮৮ ও মোশতাক আহমেদ রউফ মোস্তফা হরিণ প্রতীকে-২৯৫৯ এবং জাকের পার্টির প্রার্থী জহিরুল আলম গোলাপ ফুল প্রতীকে-৩৪০৫ পেয়েছেন।
ইসলামী আন্দোলনের মেয়র প্রার্থী হাফিজ মাওলানা মাহমুদুল হাসান পেয়েছেন ১২৭৯৪ ভোট। এই সিটিতেও ইসলামী আন্দোলনের মেয়র প্রার্থী হাফিজ মাওলানা মাহমুদুল হাসান ভোট বর্জন করেন। এই সিটিতে মুল প্রতিদ্বন্দ্বীতা হয় নৌকা ও লাঙ্গল প্রার্থীর মধ্যে। এদিকে সিলেট নির্বাচনের ফলাফর প্রত্যাখ্যান করে জাতীয় পার্টির প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাবুল সাংবাদিকদের বলেন,এটা পাতানো নির্বাচন ছিলো। আমার কোন এজেন্টকে কেন্দ্রে থাকতে দেয়া হয়নি।রিটার্নিং কর্মকর্তা ফয়সাল কাদের বলেন,সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৪৬ শতাংশ।
সিলেটে বুধবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ইভিএমে চলে ভোটগ্রহণ। ভোটগ্রহণের সময় বিকাল ৪টা পর্যন্ত থাকলেও কয়েকটি কেন্দ্রে ভোটারদের লাইন থাকায় ৪টার পরেও ভোট নেয়া হয়। বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ শুরুর আগে-সকাল ৭টা থেকেই লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন ভোটাররা। ইভিএম-এ ভোট দেওয়া নিয়ে এক ধরণের কৌতুহল কাজ করেছিলো তরুণ ভোটারদের মধ্যে। উৎসাহ-উদ্দীপনায় নারী-পুরুষ ভোটাররা তাদের ভোট প্রদান করেন।
প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রে পুরুষের চাইতে নারী ভোটারের উপস্থিতি ছিলো চোখে পড়ার মত। সকাল ৮টায় পাঠানটুলা জামেয়া কেন্দ্র্রে ভোট দিয়ে নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। এদিকে সকাল ৯ টায় আনন্দ নিকেতন স্কুল কেন্দ্রে ভোট দিয়ে নির্বাচনে পেশিশক্তির প্রয়োগ করার অভিযোগ করেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাবুল।
অন্য প্রার্থীরা নিজ নিজ কেন্দ্রে ভোট প্রদান করেন। এদিকে ভোটকে কেন্দ্র করে সিলেট জুরে ছিলো প্রশাসনের কঠোর নজরদারি। শেষ পর্যন্ত কোথাও কোন সহিংসতার খবর পাওয়া যায়নি। এবারের সিসিক নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র ছিলো ১৯০টি। এরমধ্যে ১৩২ কেন্দ্রকে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ (ঝুঁকিপূর্ণ) হিসেবে চিহ্নিত করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
এবার বর্ধিত এলাকাসহ মোট ৪২ ওয়ার্ডে ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ৮৭ হাজার ৭৪৭ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ৫৪ হাজার ৩৬৩ জন ও নারী ভোটার রয়েছে ২ লাখ ৩৩ হাজার ৩৮৪ জন। ঝুঁঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ১৭ জন সদস্য দায়িত্ব পালন করেছেন। আর সাধারণ ভোটকেন্দ্রে ১৬ জন সদস্য ছিলেন। ভোটকেন্দ্রের বাইরেও ছিলো বিশেষ নিরাপত্তা বলয়।
ইসির ভাষ্য :ভোটের দিন সকাল আটটা থেকে রাজধানীর আগারগাঁও নির্বাচন ভবনের বেজমেন্টে স্থাপিত সিসিটিভি মনিটরিং কন্ট্রোল রুম থেকে দুই সিটির ভোট পর্যবেক্ষ করেছে ইসি। এসময় কন্ট্রোলরুমে উপস্থিত ছিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব খান, রাশেদা সুলতানা ও মো. আলমগীর।
ইসি জানায়, সিলেট সিটিতে ৩ হাজার ২০৪টি এবং রাজশাহীতে ২ হাজার ৫০০টি ইভিএমের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ শুরু হয়। আর সিলেটে ১ হাজার ৭৪৭টি সিসি এবং রাজশাহীতে ১ হাজার ৪৬৩টি সিসি ক্যামেরা দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছে কমিশন। ভোট শুরুর দুই ঘন্টা পরপর সাংবাদিকদের ভোটের পরিস্থিতি জানান ইসি।
ভোট পরবর্তি সংবাদ সম্মেলনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের বলেন, পাঁচ সিটি করপোরেশন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে উৎসাহিত করবে। কেননা, পাঁচটি সিটি নির্বাচন ভালো হয়েছে। আমরা দিনভর নির্বাচন মনিটরিং করেছি।
নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, আনন্দমুখর পরিবেশ সম্পন্ন হয়েছে। আধাঘণ্টা প্রবল বৃষ্টির কারণে কিছুটা ব্যাঘাত হলেও ভোটগ্রহণ বন্ধ হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই নির্বাচন হয়েছে। আমরা যে কারণে সন্তুষ্ট বোধ করছি, কোনো রকম অপ্রীতকর ঘটনা ঘটেনি। যেটা নির্বাচনে প্রত্যাশা থাকে, ভোটার অবাধে এসে ভোট দিতে পারেন কি না, সেই প্রশ্নে আমরা বলবো তারা এসেছেন। অবাধে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন।
কোথাও বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার খবর আমরা পাইনি। আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে নজর রাখছিলাম। তিনি বলেন, রাজশাহীতে আনুমানিক ৫২ থেকে ৫৫ শতাংশ উপস্থিত হয়েছেন। সিলেটে কমেবেশি ৪৬ শতাংশ উপস্থিতি ছিল বলে জানতে পেরেছি। কিছুটা হেরফের হতে পারে। বাসাইল পৌরসভা নির্বাচনও ভালো হয়েছে। সেখানে ৭০ শতাংশ ভোটার উপস্থিত ছিলেন। শতভাগ ভোট কখনোই নিশ্চিত হয়নি। পৃথিবীর কোথাও শতভাগ ভোট পড়ে না। ৫০ শতাংশ ভোট গুড এনাফ। ৬০-৭০ শতাংশ হলে এক্সিলেন্ট। আমরা চেষ্টা করে যাবো।
রাজশাহী সিটিতে এক নারী বারবার গোপনকক্ষে প্রবেশ করায় ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, সেটা আমরা তদন্ত করবো। সিসি ক্যামেরায় আমরা দেখেছি একজন নারী একাধিকবার ভেতরে যাচ্ছেন।
পরে জানতে পেরেছি বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট তাকে তিন দিনের সাজা দিয়েছেন। এটা একটা দৃষ্টান্ত হতে পারে, যে ম্যালপ্র্যাকটিসের জন্য সাজা হতে পারে। তবে সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা দেখলেন না কেন, আমরা সেটা তদন্ত করে অবশ্যই ব্যবস্থা নেবো।