আজ ১লা ডিসেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ ও ১৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ এবং ১৭ই জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

অর্থলোভী ডাঃ এর অবহেলা ও অতি মুনাফার আকাঙ্খাঃ সিজার ডেলিভারি এখন মহামারি

  • In স্বাস্থ্য
  • পোস্ট টাইমঃ ২১ জুন ২০২৩ @ ১২:৪৯ অপরাহ্ণ ও লাস্ট আপডেটঃ ২১ জুন ২০২৩@১২:৪৯ অপরাহ্ণ
অর্থলোভী ডাঃ এর অবহেলা ও অতি মুনাফার আকাঙ্খাঃ সিজার ডেলিভারি এখন মহামারি

।।বিশেষ প্রতিবেদন।।

টাকার লোভে মহামারিতে রূপ নিয়েছে প্রচলিত সিজার ডেলিভারি। শহর থেকে গ্রামাঞ্চলে বেশি চলছে সিজারের নামে ব্যাপক বাণিজ্য। দেশে সরকারি হাসপাতালে ডেলিভারি করাতে মানুষের পকেট থেকে খরচ হয় মোট ব্যয়ের ৬৫ শতাংশ। বেসরকারিতে শতভাগই নিজেদের টাকা ডেলিভারিতে ব্যয় করতে হয়। ২০২২সালে সিজারে সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে ৮৪শতাংশই হয়েছে বেসরকারি হাসপাতালে। বাকি ১৪শতাংশ হয়েছে সরকারি হাসপাতালে আর ২শতাংশ হয় এনজিও পরিচালিত স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন- নিরাপদ সিজার না হলে মা-সন্তানের ডেলিভারি পরবর্তী নানা রকম শারীরিক ঝুঁকি থাকে। স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দিনদিন বাড়লেও ব্যবসায়িক মানসিকতা ও অতি মুনাফা লাভের আশায় স্বাভাবিক প্রসবের চেয়ে অস্ত্রোপচারে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। যা দেশের জন্য মহাবিপদের বার্তা ও ভয়ঙ্কর। এজন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়মের মধ্যে আনা জরুরি বলে জানান বিশেষজ্ঞগণ।

রাজধানীর গ্রিন রোডের ‘সেন্ট্রাল হাসপাতাল’ এ ভুল চিকিৎসায় এক নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনায় শুধু এককভাবে চিকিৎসকরাই দায়ী নন, হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা কমিটিও বিশেষতঃ দায়ী। সূত্র জানায়- গত তিন মাস ধরে সেন্ট্রাল হাসপাতালের গাইনি ও প্রসূতি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সংযুক্তা সাহার অধীনে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন মাহবুবা রহমান আঁখি। এ সময় তার শারীরিক অবস্থা “স্বাভাবিক” ছিল বলেও চিকিৎসক জানিয়েছিলেন। নরমাল ডেলিভারির মাধ্যমেই সন্তান প্রসব সম্ভব ছিল আশ্বস্তও করেছিলেন ডা. সংযুক্তা সাহা। প্রসব ব্যথা ওঠায় গত ৯জুন দিবাগত রাত ১২টা ৫০মিনিটে সেন্ট্রাল হাসপাতালে ডা. সংযুক্তার অধীনে মাহবুবাকে ভর্তি করা হয়। ঐ সময় ডা. সংযুক্তা সাহা দেশেই ছিলেন না। অথচ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীর স্বজনদের জানায়, সংযুক্তা সাহা আছেন এবং ওটিতে (অপারেশন থিয়েটার) কাজ করছেন। অন্য চিকিৎসকের মাধ্যমে স্বাভাবিক প্রসবের চেষ্টা ব্যর্থ হলে অস্ত্রোপচার করে বাচ্চা বের করা হয়। পরদিন মারা যায় শিশুটি। শিশুটির মা পরে মৃত্যুবরণ করেন। কারণ সিজারের সময় হৃদরোগে আক্রান্ত হন তিনি।

হাসপাতালের কার্ডিয়াক কেয়ার ইউনিট ত্রুটিপূর্ণ থাকায় ঐ সেবা থেকে বঞ্চিত হন তিনি এ বিষয়টি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তদন্তে বের হয়ে এসেছে। অনেকেই বলছেন- প্রখ্যাত শিশু বিশেষজ্ঞ জাতীয় অধ্যাপক ডা. এম আর খান যতদিন সেন্ট্রাল হাসপাতাল পরিচালনা করেছিলেন, ততদিন অনেক সুন্দরভাবে হাসপাতালটি পরিচালিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন- খোদ রাজধানীর বেসরকারি হাসপাতালে এই চিত্র থাকলে ঢাকার বাইরের কী অবস্থা! সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রতিদিন সিজারের নামে অসংখ্য শিশু ও মা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন দেশের কোথাও না কোথাও। দেশে ৮০থেকে ৯০ভাগ সিজার অপারেশন হচ্ছে। বেশির ভাগই ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু গ্রামে বা মফস্বলে কোনো ঘটনা ঘটলে এতটা হইচই হয় না, ঢাকায় যেমনটা হচ্ছে। এগুলো দেখভাল করার দায়িত্ব স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য), সিভিল সার্জনদের। কিন্তু অধিকাংশই দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেন না। তবে অনেক কর্মকর্তা নিয়মিত মাসোহারা পেয়ে থাকেন।

সম্প্রতি র‍্যাবের সাবেক ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম যাত্রাবাড়ীর একটি বেসরকারি ক্লিনিকে অভিযানে গিয়ে দেখেন- এক প্রসূতিকে আয়া’রা সিজার করছেন। এর আগে মোহাম্মদপুরে এক ক্লিনিকে ভুয়া ডাক্তার অপারেশন করছিলেন। রোগী রেখে পালিয়ে যাওয়ার সময় তাদের আটক করা হয়। এসব বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিকগুলোতে নিয়মিত মনিটর না করায় ও এদের জবাবদিহিতা না থাকায় আজকে সিজারের নামে বাণিজ্য মহামারি রূপ নিয়েছে।

ঢাকার বাইরে একটি ক্লিনিকে যে যন্ত্রপাতি ও ব্যবস্থাপনা থাকার কথা, তার কিছুই নেই। শতকরা ৮০ভাগেরই লাইসেন্স নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আবেদন করেই ক্লিনিক, হাসপাতাল চালু করে দিয়েছে। এদের কাছ থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট বিভাগ নিয়মিত ঘুষের ভাগ পান। এমন অভিযোগও পাওয়া গেছে। এজন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা দায়ী। শুধু চিকিৎসকদের গ্রেফতার করার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেকে। তারা বলেন, তদন্তের মাধ্যমে দোষী প্রমাণিত হলে গ্রেফতার করুক কিন্তু তদন্ত না করে যে দোষী নয়, তাকে গ্রেফতার করলে মানুষ চিকিৎসা পেশায় আসতে নিরুত্সাহিত হবে। তদন্ত করে প্রকৃত দোষীদের গ্রেফতার করার পরামর্শ দেন তারা।

সেন্ট্রাল হাসপাতালের ঘটনাটি তদন্ত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সাত দফা নির্দেশনা দিয়েছে। এগুলো হলো ১. ডা. সংযুক্তা সাহা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লিখিত অনুমোদন ছাড়া পরবর্তী সময়ে সেন্ট্রাল হাসপাতালে কোনো বিশেষজ্ঞ সেবা দিতে পারবেন না। ২. আইসিইউ ও জরুরি সেবার মান সন্তোষজনক না হওয়ায় অপারেশন থিয়েটারের কার্যক্রম পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে। ৩. প্রসূতি মাহবুবা রহমান আঁখির পরিবারের নিকট থেকে গৃহীত চিকিৎসাবাবদ সব খরচ এবং চিকিৎসাজনিত জটিলতার যাবতীয় ব্যয় সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বহন করবে। ৪. রোগীর চিকিৎসায় জড়িত সব চিকিৎসকের এবং চিকিৎসা সংক্রান্ত যাবতীয় কাগজপত্র বিএমডিসিতে পাঠাতে হবে। বিএমডিসি থেকে চিকিৎসকের নিবন্ধনবিষয়ক সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে তদানুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ৫. ভুক্তভোগী কোনো ক্ষতিপূরণ দাবি করলে বিদ্যমান আইনি প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করতে হবে। ৬. আদালতে চলমান মামলায় অভিযুক্ত ডা. শাহজাদী ও ডা. মুনার যাবতীয় খরচ সেন্ট্রাল হাসপাতালকে বহন করতে হবে। ৭. অভিযোগ সংক্রান্ত সব কাগজপত্র স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে পাঠাতে হবে। পরবর্তী সময়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

অতীতে গ্রামাঞ্চলে আগে এক দম্পতির ৮থেকে ১২ টা সন্তান হতো। সবই হতো সাধারণ ডেলিভারি। আধুনিক যুগে বিজ্ঞানসম্মতভাবে সন্তান প্রসব করা হচ্ছে। দেশের প্রতিটি ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে মা ও শিশু হাসপাতাল ও সাব সেন্টারে প্রশিক্ষিত জনবল রয়েছে। যেখানে নিরাপদ ডেলিভারি করা সম্ভব। ২০২২সালে ঘরে স্বাভাবিক প্রসবে শিশু জন্মদান হয়েছে ১২লাখ ৬২হাজার ৩২৪জন। সরকারি হাসপাতালে ৬লাখ ৪৭হাজার ৪৩৮জন শিশুর জন্ম হয়েছে। যাদের মধ্যে সিজার হয়েছে ২লাখ ৩৩হাজার ৭৮জনের। বেসরকারি হাসপাতালে ১৬লাখ ৩১হাজার ২৫৫জন শিশুর জন্ম হয়েছে। যাদের মধ্যে ১৩লাখ ৫৩হাজার ৯৪২জনের সিজার হয়েছে। আর এনজিও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ৬১হাজার ৪৮৯জন শিশুর জন্ম হয়েছে। যাদের মধ্যে সিজারে হয়েছে ২২হাজার ১৩৬জন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন- সেন্ট্রাল হাসপাতালে নবজাতকের মৃত্যু ও তার মায়ের মৃত্যুর ঘটনাটি তদন্ত করা হয়েছে। ত্রুটি পেয়েছি। ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ঢাকার বাইরেরগুলোর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

গাইনি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. রাশিদা বেগম বলেন- প্রয়োজন হলেই সিজার করতে হয়। মা কিংবা সন্তানের শারীরিক জটিলতা দেখা দিলে নিরাপত্তার জন্য সিজার করার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। তবে গর্ভবতী মা যদি কোনো জটিল রোগে আক্রান্ত থাকেন, কিংবা মা ও শিশুর অন্য কোনো জটিলতা থাকলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সিদ্ধান্ত নিবেন সিজার করার বিষয়ে। তবে আগে নরমাল ডেলিভারির বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে।

এদিকে সেন্ট্রাল হাসপাতালের গ্রেফতারকৃত চিকিৎসকদের মুক্তির দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)। গতকাল বিএমএর দপ্তর সম্পাদক ডা. মোঃ শেখ শহীদ উল্লাহর সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে এ দাবি জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়- বিএমএ সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন এবং মহাসচিব ডা. মোঃ ইহতেশামুল হক চৌধুরী এক বিবৃতিতে দুই চিকিৎসকের গ্রেফতারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার আগেই শুধু অভিযোগের ভিত্তিতে বেসরকারি সেন্ট্রাল হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. শাহজাদী ও ডা. মুনাকে গ্রেফতার ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন তারা। বিএমএ অবিলম্বে গ্রেফতারকৃত চিকিৎসকদের মুক্তির দাবি করেছে।

সর্বোপরি বিজ্ঞজনেরা মনে করেন, একজন প্রসূতি মাকে সবার আগে নরমাল ডেরিভেলিতে উদ্বুদ্ধ করা উচিত। যুগ থেকে যুগান্তরে নরমাল ডেলিভারি হয়ে আসছে। কিন্তু এখন শুধু আর্থিক লোভের কারণে প্রসূতি মায়েদের সিজারে প্রলুব্ধ করা হয়। এর জন্য আমাদের মানবিক অবক্ষয় দায়ী। আমাদের আগে মানুষ হওয়া উচিত, তারপর সেবা।

নিউজ শেয়ারঃ

আরও সংবাদ

জনপ্রিয় সংবাদ

সর্বশেষ সংবাদ

আলোচিত সংবাদ

নিউজ শেয়ারঃ
 ঘোষণাঃ
বিডি হেডলাইন্স ২৪ ডট কম
শিরোনামঃ
Verified by MonsterInsights