আজ ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ ও ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ এবং ২১শে মহর্‌রম, ১৪৪৬ হিজরি

পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার সুযোগ নেইঃ বাড়ছে রাজস্ব কর

  • In জাতীয়
  • পোস্ট টাইমঃ ১৬ মে ২০২৩ @ ১২:১৫ অপরাহ্ণ ও লাস্ট আপডেটঃ ২০ মে ২০২৩@০৬:৩১ অপরাহ্ণ
পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার সুযোগ নেইঃ বাড়ছে রাজস্ব কর

বিডিহেড লাইন্স ডেস্ক:

পাচার করা অর্থ বিনা প্রশ্নে দেশে ফিরিয়ে আনার বিধান থাকছে না এবারের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে। সম্পদশালীদের ওপর বাড়ানো হতে পারে সারচার্জ। পাশাপাশি সহজ করা হবে সারচার্জ আদায় প্রক্রিয়া। আর ‘মেড ইন বাংলাদেশ ট্যাগ লাইন’ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে এবারও দেশি শিল্পের জন্য থাকবে সুরক্ষা। কর আদায়ে বাড়াতে গ্রামাঞ্চলে নিয়োগ হবে প্রাইভেট এজেন্ট।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। ধনী করদাতাদের আয়করের ওপর এখন ১০ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত সারচার্জ বিদ্যমান থাকবে। ব্যক্তি বা করদাতার সম্পদসীমা ১০থেকে ২০কোটি টাকার মধ্যে থাকলে তাকে ২০শতাংশ সারচার্জ দিতে হয়। আর ২০থেকে ৫০কোটি টাকা পর্যন্ত সম্পদের ওপর ৩০শতাংশ এবং ৫০কোটি টাকার ওপরে সম্পদের জন্য সারচার্জ দিতে হয় ৩৫শতাংশ। এছাড়া তিন থেকে ১০কোটি টাকা পর্যন্ত সম্পদ থাকলে, নিজ নামে একাধিক গাড়ি থাকলে বা সিটি করপোরেশন এলাকায় ৮হাজার বর্গফুটের অধিক আয়তনের আবাসিক সম্পত্তি থাকলে ন্যূনতম ১০শতাংশ সারচার্জ দিতে হয়।

রাজস্ব বোর্ড সূত্রে আরো জানা যায়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণ করতে আগামী তিন অর্থবছরে বাংলাদেশকে রাজস্ব হিসেবে দুই লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা আয় করতে হবে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরেই রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে ৬৫হাজার কোটি টাকা। বাজেটে বিদ্যমান সারচার্জ ৫থেকে ১০শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হতে পারে। ফলে ধনীদের দিতে হতে পারে আরও উচ্চ কর। সেদিক থেকে ধনীদের কর দিতে একটু ভাবনায় পড়তে হতে হবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজস্ব বোর্ডের এক কর্মকর্তা জানান, সারচার্জ যৌক্তিক হারে বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হতে পারে। বর্তমান কঠিন অর্থনৈতিক বাস্তবতায় রাজস্ব আদায় যখন কঠিন হয়ে পড়েছে, তখন ধনীদের কাছ থেকেও সহযোগিতা প্রয়োজন। এছাড়া আরও সহজ করা হতে পারে সারচার্জ কাঠামোর প্রস্তাব।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সহ-সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, ধনীরা বেশি কর দেবে, কেননা তারা বেশি সুযোগ সুবিধা ভোগ করে। কিন্তু কিছু নাগরিক সুবিধা পেতে সব ধরনের নাগরিককেই বিড়ম্বনার স্বীকার হতে হয়। ড্রাইভিং লাইসেন্স থেকে শুরু করে কিছু নাগরিক সুবিধা পেতে এ ধরনের ভোগান্তি কমাতে সরকারের উদ্যোগ নেওয়া উচিত। আমি বেশি ট্যাক্স দেবো, কিংবা নাগরিক সুবিধার জন্য বেশি অর্থ খরচ করতেও রাজি আছি। কিন্তু ভোগান্তিহীন নাগরিক সুবিধা চাই।

সারচার্জ কী?
সারচার্জ হচ্ছে এক ধরনের ‘অতিরিক্ত কর’। ব্যক্তি শ্রেণির করদাতাদের ক্ষেত্রে কারও নির্দিষ্ট সীমার বেশি সম্পদ থাকলে নিয়মিত কর দেওয়ার সঙ্গে ‘বাড়তি’ এই সারচার্জও পরিশোধ করতে হয়। নিট সম্পদের ওপর ভিত্তি করে এটি ধার্য করা হয়। একে ‘সম্পদজনিত’ করও বলা হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, একজন করদাতার সাড়ে তিন কোটি টাকার নিট সম্পদ রয়েছে। এর বাইরে চাকরি থেকে বছরে আয় পাঁচ লাখ টাকা। এখানে চাকরি থেকে যে আয় আসছে, তার জন্য কর দিতে হবে। পাশাপাশি সম্পদের জন্যও দিতে হবে আলাদা সারচার্জ।

রাজস্ব বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রায় ১৫হাজার ব্যক্তি করদাতা সারচার্জ দিয়েছেন। যার পরিমাণ ৬০০কোটি টাকা। যদিও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের ব্যাংকগুলোতে এক কোটি টাকার বেশি আমানত রয়েছে এমন অ্যাকাউন্টের সংখ্যা এক লাখের ওপর। সেখানে সারচার্জ দেওয়া ব্যক্তির এমন সংখ্যা অযৌক্তিক।

রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রা বাড়তে পারে ৬০হাজার কোটি টাকাঃ

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, নতুন অর্থবছরে মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা হতে পারে পাঁচ লাখ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৫শতাংশ বেশি এবং দেশের মোট জিডিপির ১০শতাংশের সমান।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে চার লাখ ৩০হাজার কোটি টাকা আদায়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ১৬দশমিক ২শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ৩লাখ ৭০হাজার টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়বে ৬০হাজার কোটি টাকা। এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রার পাশাপাশি এনবিআরবহির্ভূত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২০হাজার কোটি টাকা আর করবহির্ভূত রাজস্ব(এনটিআর) আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫০হাজার কোটি টাকা।

পাচার হওয়া টাকা ফেরতের সুযোগ থাকছে নাঃ
অনেক সমালোচনার পরেও গত বাজেটে সরকার পাচার করা অর্থ বিনা প্রশ্নে দেশে ফিরিয়ে আনতে মাত্র ৭শতাংশ করের মাধ্যমে ‘অফশোর ট্যাক্স অ্যামনেস্টি’র বিধান প্রথমবারের মতো অর্থ আইনে যুক্ত করে। যদিও সরকারের এই উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেনি। অর্থবছরের প্রথম ১০মাসে (জুলাই-এপ্রিল) এই প্রক্রিয়ায় বিদেশ থেকে কোনো অর্থ আসেনি।

অন্যদিকে, অর্থ আইন-২০২২ এ অপ্রদর্শিত সম্পদ আয়কর রিটার্নে প্রদর্শন না করলে সমপরিমাণ জরিমানারও বিধান করা হয়। এক্ষেত্রেও কোনো বৈদেশিক সম্পদ দেশে ফেরত আসেনি।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, আগামী বাজেটে সাধারণ ক্ষমায় বিদেশে পাচার করা টাকা দেশে ফেরানোর সুযোগ থাকছে না। পাশাপাশি রিটার্নে অপ্রদর্শিত অফশোর সম্পদ বা বিদেশে স্থাবর সম্পদ দেখানোর সুযোগ বাতিল করা হচ্ছে। গত বাজেটে এ উদ্যোগ নেওয়ায় অর্থনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের তোপের মুখে পড়ে সরকার। যদিও গত বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আ.হ.ম মুস্তফা কামাল এ সুযোগে টাকা ফেরত আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন।

বাজেট পর্যালোচনা অনুষ্ঠানে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) জানায়, বাজেটে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনতে যে সুবিধা দেওয়া হয়েছে এটি কোনো কাজে আসবে না। বাজেটে দেওয়া সুবিধা অনুযায়ী কর দিয়ে পাচার হওয়া অর্থ বৈধ করা হলে আয়কর কিংবা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ প্রশ্ন তুলতে পারবে না। তবে এ উদ্যোগের ফলে বিদেশ থেকে কোনো টাকাই ফেরত আসবে না। সৎ ব্যবসায়ীরা উৎসাহ হারাবেন। এটা একটি সমস্যা।

এই প্রতিবেদক জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এ ধরনের বৈষম্যমূলক নীতিতে সৎ করদাতা নিরুৎসাহিত হয়েছেন। টাকা যে ফেরত আসবে না সেটা সব মহল থেকেই বলা হয়েছে। তবে এই সুযোগে দেশ থেকে টাকা পাচার উল্টো বাড়লো কি’না সেটা খতিয়ে দেখা দরকার। বিগত কয়েক মাসে অপ্রাতিষ্ঠানিক মার্কেটে ডলারের দাম ও ব্যাংকে ডলারের দামের পার্থক্য দেখলে বিষয়টা কিছুটা আঁচ করা যেতে পারে।

সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, টাকা যে ফেরত আসবে না সেটা সিপিডি থেকে আগেও বলা হয়েছে। এটা প্রমাণিত। যারা বিদেশে টাকা পাচার করেছে, তাদের সম্পদ দেশেও রয়েছে। অনেক দেশ ট্যাক্স রিকভারি পদ্ধতিতে পাচারকারীদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করতে পারে। আমরাও সেটা করে দেখতে পারি। পাশাপাশি অর্থপাচার রোধে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন হবে।

রাজস্ব বোর্ডের এক কর্মকর্তা জানান, ১০মাসে কোনো টাকা ফেরত না আসায় বিব্রত তারা। যারা বিদেশে টাকা পাচার করেছেন, তারা সেই টাকা ফেরত আনবেন এমন প্রত্যাশা করাও বোকামি। এছাড়া পাচার করা টাকা কেউ যদি রেমিট্যান্স হিসেবে দেশে আনেন তাহলে সেখানে সরকার আড়াই শতাংশ হারে প্রণোদনা দেবে। এতে টাকাও বৈধ হবে, তাহলে ৭শতাংশ কর দিয়ে কেন পাচারকারীরা টাকা বৈধ করবে।

করজাল বিস্তার হচ্ছে গ্রামে, মেড ইন বাংলাদেশে বাড়তি নজরঃ

দেশে মাত্র ১৮থেকে ২০লাখ মানুষ আয়কর দেন। দেশের কর জিডিপি অনুপাত ৮শতাংশের নিচে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। দেশে প্রদেয় করদাতার অধিকাংশই শহরকেন্দ্রিক। অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ নিয়েছে সরকার। শর্তস্বরূপ রাজস্ব খাতে বড় ধরনের সংস্কার করতে হবে, বাড়াতে হবে কর জিডিপি। আইএমএফের আগামী অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) দশমিক ৫শতাংশ বাড়তি কর আদায় করতে হবে। এজন্য আগামী বাজেটে বাড়তি কর আদায়ের নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

জানা যায়, আগামী অর্থবছর গ্রামাঞ্চল থেকে কর সংগ্রহ করতে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত বেসরকারি কর সংগ্রহ এজেন্ট নিয়োগ করার কথা ভাবা হচ্ছে।

রাজস্ব বোর্ড সূত্রে জানা যায়, গ্রামের মানুষকে করজালের আওতায় আনতে উন্নত দেশের মতো বিভিন্ন জেলায় কর এজেন্ট নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে। নতুন কর এজেন্টরা নতুন করদাতাদেরও সাহায্য করবে। ই-টিআইএন থাকা সত্ত্বেও যারা এখনো কর রিটার্ন জমা দেননি, তাদের রিটার্ন প্রস্তুত করতেও সহায়তা করবে। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ.হ.ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে বৈঠকে এনবিআর কর্মকর্তারা এ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করেন।

প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন সাপেক্ষে বাজেটের অর্থ বিলে ‘ইনকাম ট্যাক্স প্রিপেয়ারার (আইটিপি)’ নামে একটি নিয়ম অন্তর্ভুক্ত করা হবে। যার খসড়াও প্রস্তুত করা হয়েছে।

ধনীদের করের বোঝা বাড়বেঃ
থাকছে না পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার সুযোগ পাচার করা অর্থ বিনা প্রশ্নে দেশে ফিরিয়ে আনার বিধান থাকছে না ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে। সম্পদশালীদের ওপর বাড়ানো হতে পারে সারচার্জ। পাশাপাশি সহজ করা হবে সারচার্জ আদায় প্রক্রিয়া। আর ‘মেড ইন বাংলাদেশ ট্যাগ লাইন’ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে এবারও দেশি শিল্পের জন্য থাকবে সুরক্ষা। করজাল বাড়াতে গ্রামাঞ্চলে নিয়োগ হবে প্রাইভেট এজেন্ট

নিউজ শেয়ারঃ

আরও সংবাদ

জনপ্রিয় সংবাদ

সর্বশেষ সংবাদ

আলোচিত সংবাদ

নিউজ শেয়ারঃ
শিরোনামঃ
Verified by MonsterInsights