শাহীন মাহমুদ রাসেল
কক্সবাজার প্রতিনিধি।।
আশ্রয় শিবিরের নিরাপত্তা বেষ্টনী ডিঙিয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে রোহিঙ্গারা। তারা মাদক বেচাকেনাসহ নানা অপরাধ করছে। এ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রায় লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে আটক করে ক্যাম্পে ফেরত পাঠিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আরো কয়েক লক্ষাধিক রোহিঙ্গা দেশের বিভিন্ন এলাকায় নানা পরিচয়ে আত্মগোপনে রয়েছে বলে জানা গেছে। শুধু তাই নয়, গহীন অরণ্যে গড়ে তুলেছে অপরাধের স্বর্গরাজ্য। মাদক ও অস্ত্র পাচারের মতো কাজে জড়িয়ে পড়ছে তারা। যা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নজরের বাইরে কিংবা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সেই পর্যন্ত যাওয়া সম্ভবই হয় না।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার এবং দ্রুত ধনী হতে হিংস্র হয়ে উঠছে তারা। জড়িয়ে পড়ছে অপরাধে। তৈরি হচ্ছে অপরাধীদের গ্রুপ ও উপ-গ্রুপ। ক্যাম্পে আধিপত্য ধরে রাখতে প্রায়ই সংঘাত হচ্ছে। ব্লকে ব্লকে মাদক, মানব পাচার, অস্ত্র ব্যবসা, চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে। সামান্য কিছুর ঘটনা খুন পর্যন্ত গড়াচ্ছে। মিয়ানমার থেকে মাদকের চালান সরাসরি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আসার কারণে দেশের মাদকের অন্যতম ট্রানজিট পয়েন্টে পরিণত হয়েছে। শরণার্থী ক্যাম্প হয়ে প্রতিদিন শত কোটি টাকার ইয়াবা ও নতুন মাদক ক্রিস্টাল মেথ ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। এছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিষিদ্ধ সংগঠনগুলোর তৎপরতা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা), রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও), ইসলামী মাহাজ ও জমিয়তুল মুজাহিদীনের সাংগঠনিক তৎপরতা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সাধারণ ঘটনা। রোহিঙ্গা অপরাধীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে স্থানীয় কিছু দালাল। এই দালালদের মাধ্যমে রোহিঙ্গারা পেয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট।
সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে এ পর্যন্ত শতাধিক খুন হয়েছে। এতে স্থানীয় প্রশাসন ও বাসিন্দারা আতঙ্কিত। তাদের নানা অপরাধের কারণে শুধু কক্সবাজারই নয় দেশের অন্যান্য অঞ্চলের বাসিন্দারাও আতঙ্কে রয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, অপরাধের আখড়ায় পরিণত হয়েছে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির। তাই ড্রোন ক্যামেরা ও ওয়াচ টাওয়ারের মাধ্যমে বাড়ানো হয়েছে নজরদারি। চালানো হচ্ছে বিশেষ অভিযান। রোহিঙ্গারা ক্যাম্প থেকে বের হওয়ার সুযোগে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে মানব পাচারকারী চক্র। ইতোমধ্যে এই চক্রের বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এদিকে শনিবার (১৬ সেপ্টেম্বর) রাতে উখিয়া ডিগ্রি কলেজের সামনের চেকপোস্টে তল্লাশি চালিয়ে অবৈধভাবে বেরিয়ে আসা ২৯ জন রোহিঙ্গা আটক করা হয়। এর একদিন আগে একই স্থানে চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চালিয়ে বিভিন্ন ক্যাম্পের আরও ২৯ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে ক্যাম্পে পুশব্যাক করেন।
বিষয়টি নিশ্চিত করেন উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শেখ মোহাম্মদ আলী।
তিনি জানান, উখিয়া বিভিন্ন ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা এপিবিএনের নিরাপত্তা ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে বেরিয়ে আসা ২৯ জন রোহিঙ্গাদের আটক করা হয়। আটক রোহিঙ্গারা রেজিষ্টার্ড ক্যাম্প, ক্যাম্প নং-১ডব্লিউ, ১ইস্ট, ৮ইস্ট, ১২, ২ইস্ট, ১৫, ৮ডব্লিউ, ৮ওয়েস্ট, ১২, ১৩, ৭, ১৮, ১১ ও ১৪ নং ক্যাম্পের বাসিন্দা।
তিনি আরও জানান, আটককৃত রোহিঙ্গাদের আইনী ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য কুতুপালং রেজিস্টার্ড ক্যাম্পের সিআইসির কাছে পাঠানো হয়েছে।
স্থানীয় পুলিশ ও অন্যান্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বর্তমানে যে অবস্থায় রোহিঙ্গাদের রাখা হয়েছে, তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। তাদের মধ্যে হানাহানি, সংঘর্ষ, খুন, গুম বেড়েই চলছে। রোহিঙ্গারা খুবই বেপরোয়া ও হিংস্র। দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা বেষ্টনিতে জায়গা নির্ধারিত করলেও তা তেমন কাজে আসছেনা বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
তাদের মতে, এক শ্রেণীর এনজিওর কারণে রোহিঙ্গারা সন্ত্রাসসহ জঙ্গিবাদের মতো ভয়ঙ্কর কর্মকান্ডে লিপ্ত হচ্ছে। আর এসব কাজে অর্থ যোগান দিচ্ছে ওই সব এনজিও। ভাসানচরের মতো সুন্দর নিরাপদ পরিবেশে রোহিঙ্গাদের জন্য প্রস্তুত রাখা হলেও এনজিওগুলোর কারণে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর করা সম্ভব হচ্ছে না। এই এনজিওগুলো আন্তর্জাতিক মহলে রোহিঙ্গাদের নিয়ে মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে। রোহিঙ্গাদের সাহায্য-সহযোগিতার নামে এরা কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে আসছে। আর এনজিও কর্মকর্তারা সমুদ্র সৈকতে বিলাসবহুল জীবন-যাপন করছেন।
সূত্র বলছে, ক্যাম্পের প্রবেশদ্বারে রোহিঙ্গাদের ছড়িয়ে পড়া বন্ধে বসানো হয়েছে এপিবিএন পুলিশের চেকপোস্ট। কিন্তু অনেক সময় চেকপোস্টগুলোর শিথিলতার সুযোগে ফাঁকফোকর দিয়েও বের হচ্ছে রোহিঙ্গারা। একই সঙ্গে মেরিন ড্রাইভ কিংবা কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কে তুলে নেয়া হয়েছে অনেক চেকপোস্ট। স্থানীয়দের দাবি, ক্যাম্প ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গারা দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি।
কক্সবাজার জেলা পুলিশ সূত্রে যায়, গত ছয় বছরে বিভিন্ন অপরাধে অভিযুক্ত হওয়ায় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ৩ হাজার ২০টি মামলা করা হয়েছে। নামে আসামি করা হয়েছে ৬ হাজার ৮৩৭ জনের বিরুদ্ধে। অজ্ঞাত আসামি রয়েছে অন্তত ৫ হাজার।
সূত্র মতে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দায়েরকৃত ২ হাজার ৫৭টি মামলায় ২ হাজার ৯৭৯ জন রোহিঙ্গাকে আসামি করা হয়েছে। অস্ত্র আইনে ২৩৮টি দায়েরকৃত মামলায় ৫৫২ জন রোহিঙ্গাকে আসামি করা হয়েছে। ১৩১টি হত্যা মামলায় ৯৯১ জন রোহিঙ্গাকে আসামি করা হয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ৯৪টি ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টা মামলায় ১১৪ জন রোহিঙ্গাকে আসামি করা হয়েছে। ৬২টি ডাকাতি ও ডাকাতির চেষ্টা মামলায় ৫৩৫ জন রোহিঙ্গাকে আসামি করা হয়েছে। বিশেষ ক্ষমতা আইনে দায়েরকৃত ৬৫টি মামলায় ১৩৩ জন রোহিঙ্গাকে আসামি করা হয়েছে। ৪৪টি অপহরণ মামলায় ২২২ জন রোহিঙ্গাকে আসামি করা হয়েছে। ৩৭টি মানব পাচার মামলায় ১৮৯ জন রোহিঙ্গাকে আসামি করা হয়েছে। সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশের অভিযোগে ফরেনার্স অ্যাক্টে দায়েরকৃত ৪২টি মামলায় ১০৪ জন রোহিঙ্গাকে আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া আরও বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগে দায়েরকৃত ২৪৩টি মামলায় ৯৪১ জন রোহিঙ্গাকে আসামি করা হয়েছে।
কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত ছয় মাসে রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে ২৩ জন মাঝিসহ ৬০টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এই খুনের মধ্যে ক্যাম্পের বাইরে থেকে অপহরণ করে নেওয়া ১১ জন স্থানীয় রয়েছে।
গত জুলাই পর্যন্ত পরিসংখ্যান বলছে, কক্সবাজারের উখিয়া, টেকনাফ ও নোয়াখালীর ভাসানচরে মোট ১০ লাখ ৩২ হাজার ৩৪৩ জন রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে। এর মধ্যে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা ৯ লাখ ৬১ হাজার ৭২৯ জন। এর আগে আসা পুরোনো রোহিঙ্গা রয়েছে ৩৭ হাজার ৭৮২ জন। ভাসানচরে রয়েছে ৩২ হাজার ৮৩২ জন রোহিঙ্গা।
উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্য হেলাল উদ্দিন বলেন, গেল ৬ বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও প্রত্যাবাসন করা হয়নি। আর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কোনো আশাও দেখছি না। এর কারণে রোহিঙ্গারা ক্যাম্প ছেড়ে লোকালয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। রোহিঙ্গারা ক্যাম্প ছেড়ে যেভাবে বের হচ্ছে এটা খুবই আতঙ্ক ও উদ্বেগের বিষয়। এটা দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকির বলে মনে করছি।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা মাহমুদুল হক চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ার কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দিন দিন অবনতি হচ্ছে। এভাবে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ছেড়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে। তাই সরকার, প্রশাসন, সকল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প ছেড়ে বের হয়ে যাওয়া বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি কক্সবাজার-টেকনাফ সড়ক ও মেরিন ড্রাইভে চেকপোস্টগুলো সচল করে নজরদারি বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। তা নাহলে রোহিঙ্গারা দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
তবে ক্যাম্পের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এপিবিএন বলছে, রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প ছেড়ে ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, নতুন করে অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের সমাজে মিশে যেতে দেওয়া যাবে না। সরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে তাদের কোনও নির্দিষ্ট স্থানে রাখার ব্যবস্থা করা দরকার। একইসঙ্গে তাদের একটি তালিকা তৈরি করে রাখা উচিৎ যাতে পরবর্তীতে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সহজ হয়। রোহিঙ্গারা সমাজে মিশে গেলে নানা অপকর্মে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
কক্সবাজার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, আন্তর্জাতিক শরণার্থী আইন অনুযায়ী দেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের একটি নির্দিষ্ট এলাকায় রাখার ব্যবস্থা করা দরকার। বিশেষ করে এসব রোহিঙ্গা এখন যে ক্যাম্পগুলোতে রয়েছে, সেখান থেকে যাতে কোথাও যেতে না পারে সেজন্য দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
কক্সবাজার সিটি কলেজের ট্যুরিজম অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মঈনুল হাসান চৌধুরী পলাশ বলেন, রোহিঙ্গা অপরাধীদের কারণে কক্সবাজারের সার্বিক পরিস্থিতি বিষিয়ে উঠেছে। খুবই উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে ক্যাম্প ছাড়াও রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা শহরসহ জেলার অধিকাংশ খুনের সঙ্গে জড়িত। তাদের কারণে টেকনাফের পর্যটন স্পষ্টগুলো হুমকির মুখে। সেখানে নিয়মিত অপহরণ ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে।রোহিঙ্গাদের পেশাদার অপরাধী আখ্যা দিয়ে তাদের অপরাধ দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আলাদা ব্যাটালিয়ন গঠনের দাবি জানান তিনি।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম বলেন, ক্যাম্পে অপরাধীদের ধরতে এপিবিএনের পাশাপাশি জেলা পুলিশও কাজ করছে। অপরাধ দমনে সর্বদায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সজাগ রয়েছে।