নাজমুস সাকিব
ময়মনসিংহ প্রতিনিধি।।
মৎস্য চাষিদের ধারণা, চিংড়ির ঘেরে কাঁটা শ্যাওলা থাকলে বাগদা চিংড়ির উৎপাদন ভালো হয়। সম্প্রতি বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই ধারণার প্রমাণ মিলেছে। সেই সঙ্গে কী পরিমাণ কাঁটা শ্যাওলা ঘেরে থাকলে চিংড়ির উৎপাদন ভালো হবে তা নিয়েও গবেষণা চলছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) দুই বছরের গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করেছে, কাঁটা শ্যাওলা চিংড়ির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে যেমন বাড়িয়ে তোলে তেমনি ক্ষতিকর রোগজীবাণু থেকে সুরক্ষাও দেয়।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক উপায়ে মানোন্নয়ন করা গেলে বিদ্যমান সমস্যাগুলো কমিয়ে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হবে এমন ধারণা থেকে গবেষণা শুরু করে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট। এই গবেষক দলে ছিলেন প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. তানভীরুল হক, মো. রাকিবুল ইসলাম, মো. সোয়েবুল ইসলাম ও মো. তৌহিদুল ইসলাম।
বিএফআরআই জানায়, এক ধরনের জলজ উদ্ভিদ কাঁটা শ্যাওলা অ্যাকুরিয়ামে সৌন্দর্য বর্ধনকারী উদ্ভিদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কাঁটা শ্যাওলা অনেক দেশে ‘গাপ্পি গ্রাস’ হিসেবেও পরিচিত। এটি নাজাস গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত একটি প্রজাতি। তবে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে চিংড়িচাষিদের কাছে ‘লক্ষ্মী শ্যাওলা’ নামেও পরিচিত এ জলজ উদ্ভিদটি। এটি বাংলাদেশ ছাড়াও এশিয়ার ভারত, শ্রীলঙ্কা, চীন, থাইল্যান্ড এবং আফ্রিকার কয়েকটি দেশে পাওয়া যায়।
গবেষকরা জানান, কাঁটা শ্যাওলায় ফ্লাভোনয়েড, ফেনল, পলিফেনল, অলিক অ্যাসিড, পালমিটিক অ্যাসিড, লরিক অ্যাসিড ইত্যাদি বায়োঅ্যাকটিভ উপাদান আছে। ফ্লাভোনয়েডের মধ্যে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি এবং অ্যান্টি-ভাইরাল গুণাবলি থাকায় ঘেরে চিংড়ির রোগ প্রতিরোধে ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তোলে এবং ক্ষতিকর রোগজীবাণু থেকে চিংড়িকে সুরক্ষা করে। একইভাবে, ফেনল, অলিক অ্যাসিড, পালমিটিক অ্যাসিড এবং লরিক অ্যাসিড শক্তিশালী অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে স্বীকৃত এবং প্রতিটি উপাদানেই অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল, অ্যান্টি-এলার্জিক ও অ্যান্টি-ভাইরাল বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, ঘেরের শতকরা ২০ ভাগ এলাকায় কাঁটা শ্যাওলা থাকলে ঘেরের ভৌত-রাসায়নিক গুণাগুণ ভালো থাকে এবং চিংড়ির ভালো ফলন পাওয়া যায়। এর বেশি পরিমাণে থাকলে পানির পিএইচ বেড়ে যায় এবং তখন শ্যাওলা ব্যবস্থাপনা কঠিন হয়ে পড়ে। শতকরা ২০ ভাগ কাঁটা শ্যাওলার ঘেরে ৯০ দিনের চাষে চিংড়ির গড় ওজন ৩১ গ্রাম পর্যন্ত পাওয়া গেছে, যেখানে শ্যাওলাবিহীন ঘেরে ওজন ছিল মাত্র ১৭ গ্রাম এবং শতকরা ৪০ ভাগ কাঁটা শ্যাওলার ঘেরে ছিল ২৬ গ্রাম।
গবেষক দলের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. তানভিরুল হক জানান, চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রে মাটি ও পানির ভৌত রাসায়নিক গুণাগুণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। চিংড়ির পুষ্টি ও বৃদ্ধির জন্য পানি থেকেই মূলত খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। মাটি সেই পানিকে ধরে রাখে এবং পানিতে চিংড়ির প্রাথমিক খাদ্য তৈরির জন্য যাবতীয় পুষ্টি উপাদান মাটি থেকে পানিতে মেশে। তাই পুকুরের প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং চিংড়ির স্বাস্থ্য ও বৃদ্ধিতে মাটি ও পানির ভৌত রাসায়নিক গুণাগুণ যৌথভাবে ভূমিকা পালন করে থাকে। কাজেই মাটি ও পানির ভৌত রাসায়নিক গুণাগুণ চিংড়ির উৎপাদন বৃদ্ধিতে সরাসরি প্রভাবক হিসেবে কাজ করে এবং জলাশয় বা ঘেরের সুস্থ পরিবেশ বজায় রাখার জন্য পরস্পরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, শ্যাওলাযুক্ত (২০ শতাংশ) ঘেরে ভাইব্র্রিড নামক ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি সবচেয়ে কম পাওয়া গেছে। তাছাড়া কাঁটা শ্যাওলা সমন্বিত খাদ্য ব্যবহারের ফলে মারাত্মক ভাইরাস রোগ ‘হোয়াইট স্পট সিনড্রোম ভাইরাস’ থেকে বাগদা চিংড়ি অধিক পরিমাণে সুরক্ষিত হয়। এতে বাগদার উৎপাদনও বাড়বে।